কইন্যাদের কষ্ট জানা এই আমরা

Breast Cameroonতামান্না সেতু: ওইটুকুন পথ পার হতে আমার বুকটা শুকিয়ে যেত। ছেলেটা রোজ আমাকে থামাতো ধমক দিয়ে- ‘কি ব্যাপার আমার জবাব লিখে আনিস নাই? আমি আর এক সপ্তাহ দেখবো, চিঠি না পাইলে তোর কী অবস্থা হয় দেখিস”।

আমার হাত পা কাঁপতে থাকতো। রোজ রোজ মনে হত- যদি এসিড মারে ! মার কাছে গিয়ে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করত – “মা, তুমি আমার সাথে চল। ঐ ছেলেটাকে খুব করে বকা দিয়ে দাও। আমি ভয় পাচ্ছি মা।”

কিন্তু ঠিক ওইটুকুন বয়সে আমি কঠিন বিশ্বাসের সাথে এও জানতাম, মা আমার কথা এক ফোঁটাও বিশ্বাস করবে না। এক জোড়া অবিশ্বাসী চোখে ঘৃণা নিয়ে আমাকে বলবেন- “তুই নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করছিস। না হলে সবাইকে ছেড়ে তোর সাথে এমন কেন করে? “

আমি মাকে কিছু বলতে না পেরে একা একা এমন কত যুদ্ধ করে গিয়েছি। নিজে নিজের দায়িত্ব নিয়েছি। তবুও কখনো কখনো ভুলেও যদি তাঁর কানে কোনো কথা এসেছে- আমার উষ্কখুষ্ক একগোছা চুল তাঁর হাতের মুঠায়, হাতে শক্ত একটা লাঠি। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেয়ে বলেছি -“আমি কিচ্ছু জানি না মা। বিশ্বাস করো কিচ্ছু জানি না আমি। “

হাজারো মা সেই কথা দিনের পর দিন বিশ্বাস না করে কন্যাদের একা করে দিয়েছে। যে মা থাকার কথা মেয়ের পাশে, সবার আগে পাশ থেকে চলে যায় সেই মায়েরাই!! আহারে পৃথিবী !!!

ন’মাস যে পেটে নির্ভাবনায় কাটিয়েছি, চোখ মেলে যাকে প্রথম দেখা, স্তন পান করে বড় হওয়া সেই মানুষটা আমাদের পৃথিবীর একাকিত্বের সাথে পরিচিয় করিয়ে দেয় নিজের হাতে।

আমরা সেই কন্যা যারা মাকে ভালবাসতে পারিনি। আমরা সেই কন্যা যারা নিজের শরীরকে ভালবাসতে পারিনি। আপন চাচা, ফুপা, খালুর চোখ সাপের মত দৃষ্টিতে চেটেছে এই শরীর। মগের পর মগ পানি ঢেলেছি গায়ে, একটুও কমেনি তবু অন্তরের কষ্ট। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে লাল চোখে বেসিনের আয়নায় তাকিয়ে ভেবেছি-“কেন জন্ম নিলাম” । কাউকে কিছু বলতে পারি নি। কে বিশ্বাস করবে আমাদের কথা?

এশিয়ার অঞ্চলের আমরা সেই কন্যা, যারা একটু লম্বা হতে শুরু করলেই পিঠে জোরে থাপ্পড় দিয়ে আমাদের কুঁজো করে দেয়া হয়। স্তন লুকিয়ে রাখতে গিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করা হয় না আমাদের আর।

একটা প্রাণহীন পাটখড়ির মত হাঁটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় একটুও নিতম্ব না নড়িয়ে। স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে বলে কেউ ইঙ্গিত করলে, আমাদের পাতে ভাত কম দেয়া হয়।

হায়রে আমার স্বাস্থ্য, স্তন, শরীর !!!! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেছে নিজেই নিজেকে ছুঁড়ে ফেলি ডাস্টবিনে।

সঞ্চিতা আমায় বলেছে, ওর ঋতুস্রাব হবার পর ওর মা ওকে ভীষণ মেরেছিল এই বলে -“তুই কেন বড় হয়ে গেলি? কে রাখবে তোর খেয়াল? “

সঞ্চিতা কাঁদছিল বলার সময়। আমি ওর চোখে চোখ রেখে ওর মায়ের ছেলেবেলা দেখছিলাম। যে মায়ের নিজের মাসিক হবার সাথে সাথে কত না অনিশ্চয়তার, কত অবিচারের ভেতর যেতে হয়েছিল। সেই মা তার কন্যাকেও একই সময়ে দেখে আতঙ্কে জমে গিয়ে মারার জন্য সেই কন্যা ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পায়নি। কন্যাকে নয়, এ মার তো মা দিচ্ছে নিজেকেই।

আমরা বড় কঠিন দেশের কন্যারে ভাই।
সেই আমরা যখন উঠে দাঁড়াই, ঝুঁকে যাওয়া বুক মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াই, ক্ষিপ্ত হাতে শার্টের কলার ধরি, তখন আপনাদের বুঝতে হবে- কত যুগের, কত শতাব্দীর বঞ্চনার শক্তি জমে থাকা হাত এটা। শক্তির পাহাড় বুকে নিয়ে একবার যখন ঘুরে দাঁড়াই, তখন হিমালয় কেঁপে ওঠে। এই কন্যারা যখন মা হয়ে তাদের সন্তানদের চারিদিকে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, তখন পৃথিবীর সকল কলুষিত হাত ভেঙ্গ গুঁড়িয়ে দেয়ার শক্তি নিয়েই দাঁড়ায়।

আমরা সেই কন্যা যারা জানি কন্যাদের কষ্ট। আমরা সেই কন্যা যারা জানি দিন বদলের সময় এসেছে। আমরা পাথর চোখে সন্তানদের শেখাই -“আমি তোমায় বিশ্বাস করি মাগো। কেউ তোমায় কিছু বললে জানবে মা পাশে আছে। “

আমরা আমাদের সন্তানদের পুনঃ পুনঃ বার একই জীবন দেখানো না। আমরা জাতিস্মর হয়ে বেঁচে থাকবো না।

আমরা সেই কন্যা যারা একই দিন যাপন করতে নয়, দিন বদল করতে জন্মেছি।

আপনারা হাত এবং চোখ সংযত রাখুন, বেঁধে রাখুন।

শেয়ার করুন: