দেশে আজ ‘শত কোটি বেহায়া’ প্রয়োজন

Muzzle me notসুমন্দভাষিণী: আজ যারা ব্লগার, লেখকদের নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করছে, তাদের যুক্তির ধরনটা এইরকম – ‘ও নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ‘ওরা আল্লাহ রসুলের নামে খারাপ কথা লিখে’ – সুতরাং তাকে খুন করা যায়। ঠিক তেমনিভাবে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা চালানো যায়, খুন করা যায়, দেশত্যাগে, বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা যায়, কারণ তারা ইসলাম বা আল্লাহ-রসুলের অনুসারী নয়, তারা বিধর্মী বলে। আর যেদেশের সংবিধানেই লেখা আছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা, সেখানে এসবের বিচার চাওয়াও বাতুলতা মাত্র।

‘এনকাউন্টার’-‘ক্রসফায়ারের’ নামে যে প্রহসন চলছে, যে বর্বরতা চলছে, সেখানেও দেখুন, একই যুক্তির ধারা। সন্ত্রাসীদের যেহেতু আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করা যাচ্ছে না, সুতরাং তাদের বিচার না করেই গুলি করে মেরে ফেল। বিচারের দরকার নেই। তাহলে যে আইনি প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসী ছাড়া পায় সেই প্রক্রিয়ার বিচার করবে কে? যারা এই প্রক্রিয়া চালাচ্ছে তাদের বিচার করবে কে?
আসলে যার হাতে অস্ত্র আছে, সেটা বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, ওই হাতের অস্ত্রই আইন ঠিক করে দিচ্ছে। আর কোনো যুক্তি নেই, বিচার-বিবেচনা বোধ নেই, ন্যায়-নীতি নেই। অস্ত্র ও শক্তির দম্ভই শেষ কথা। ক্ষমতায় থেকে অনায়াসে একজন শোকগ্রস্ত বাবাকেও হত্যাকারীদের আদর্শ অনুসরণকারী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়, তাতে তার ক্ষমতার একটুও এদিক-সেদিক হয় না। তাকে বা তাদের কোথাও, কারও কাছে, কোনোও আদর্শের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না।

এর মধ্যেই গুটিকয় মানুষ রাস্তায় নেমে, তাদের কলম সমুন্নত রেখে অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন অদৃশ্য মহাশক্তির সাথে। তারা নিজেদের বেহায়া ভাবতেও পিছপা হন না। এমনই একজনের কমেন্টে পাল্টা কমেন্ট দেখলাম। একজন লিখেছেন, আমাদের এখন শত কোটি “বেহায়া” দরকার আসল বেহায়াদের শায়েস্তা করার জন্য যারা কানে দিয়েছে তুলো, আর পিঠে দিয়েছে কুলো। কিন্তু এরকম বেহায়ার সংখ্যা নেহায়েতই কম।

গত সপ্তাহেই ফেনিতে সংখ্যালঘু একটি পরিবারের ওপর হামলা হলো। অর্থ উপার্জনের সব উপায় তছনছ করে দেয়া হলো। এখানেই থামলে হয়তো কথা ছিল। সাত মাসের গর্ভবতী তুলসী রানীর পেটে লাথি মারায় মৃত সন্তান প্রসব করলো সে। আমরা সেই ছবি দেখলাম অনলাইনের কল্যাণে। পুরো শরীর ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া সেই শিশুটির চোখ-মুখ-পা সবই স্বাভাবিক ছিল, চোখ ফোটাটুকুই বাকি ছিল তার। চোখ মেলার আগেই তার চোখ চিরতরে বন্ধ করে দিল সংখ্যাগুরুর দল। এ ঘটনায় মৃত্যুর সাথে লড়ে জীবন ফিরে পাওয়া অষ্টাদশী তুলসী রানী জানতে পেরেছে, সে কোনদিন আর ‘মা’ হতে পারবে না। কী দারুণ জীবন তার, তাই না? এজন্য তুলসী কাকে দোষ দেবে? নিজের জন্মকে? নাকি রাষ্ট্রকে? নাকি তার জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মকে? তাকে কে ফিরিয়ে দেবে মাতৃত্ব? ওর জায়গায় আমি হলে সমাজে সুবিধাজনক স্থানে থাকার কারণেই মামলা করতাম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু ও পারবে না, তার সেই ক্ষমতা বা যোগ্যতা বা মনোবল কোনটাই নেই।

ফিরে আসি মুক্তমনা হত্যায়। একের পর এক হত্যা চলছে, একে একাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বললেও অত্যুক্তি হবে না মোটেও। একাত্তরে সমস্ত মুক্তচিন্তার ধারকদের একে একে শেষ করে দেয়া হয়েছিল, যার ফল ভোগ করে চলেছি আমরা ৪৪টি বছর ধরে। গত ৪৪ বছরে দেশে জন্ম নেয়া নতুন মুক্তচিন্তকদের নিধনের পর্ব শুরু হয়েছে আবার। এই সাধারণ কথাটা বুঝতে উচ্চ জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, একটু চোখ-মুখ খোলা থাকলেই সম্ভব।

হত্যাকারীরা গত কয়েক দশক ধরেই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ক্ষমতাসীনরা যেমন চালিয়ে দিয়েছেন, আমরাও তা মেনে নিয়েছি। হয়তো বিচ্ছিন্নই হবে ভেবে স্বস্তির ঢেকুর তুলেছি। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের পর হত্যাকারীদের মুখোশটা বেরিয়ে এসেছে। আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও তারাও এখন আর রাখ-ঢাকের প্রয়োজন বোধ করছে না। ইসলামের নামে তারা হত্যা করে চলেছে দীর্ঘ পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক শিক্ষায় বেড়ে উঠা ‘মুক্তমনা’ অসাম্প্রদায়িক’ চেতনার মানুষজনকে। দেশকে ধীশক্তি, মেধাশক্তি থেকে বিচ্যুত করাই হত্যাকারীদের মূল লক্ষ্য। যেন কেউ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, যেন এই দেশটিই আর কখনও বিশ্বের বুকে উন্নতি করতে না পারে।

Counter Hitনষ্টদের দখলে থাকলে কারও পক্ষেই সম্ভব না অধ:পতিত জাতিকে টেনে তোলার। এই সাধারণ কথাটিই আজ বিস্মৃত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষজন। তারা ভুলে গেছে, একসময় এই চাপাতি তাদের ওপরও এসে পড়বে, তারাও স্বজন হারাতে পারে যেকোনো সময়। সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে তারা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছে ঠিকই, কিন্তু সেই সন্তান কোন আদর্শে বেড়ে উঠছে বিদেশ-বিভুঁইয়ে, সেই খবর রাখছেন কি তারা? এই সন্তানরাই যে একেকজন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তার চেয়ে ভাল ছিল না কি, এই দেশটাকেই জঙ্গিমুক্ত করে গড়ে তোলা?

এখন আর সময় আছে কি নেই, সেই বিতর্কে যাবো না। তবুও বলবো, একটুখানি বোধোদয় হোক তাদের, যারা অন্ধ থেকে প্রলয় দেখতে চাইছেন না। এক পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিয়ে আমরা মুখে যতো ফেনা তুলিই না কেন, যখন ঘরে ঘরে প্রতিদিন একেকটা ১৫ আগস্ট হচ্ছে, তখন বছর বছরের কান্নাগুলো স্রেফ ‘নাকি কান্না’তেই পরিণত হচ্ছে আজ। আমরা আজ শেখ রাসেলের মৃত্যুতে যতোটা না শোকাহত, তার চেয়ে কোনো অংশেই কম শোকাহত নই ফেনির তুলসী রানীর মৃত সন্তানকে ঘিরে, বা তার মা না হওয়ার সংবাদে। আমরা কম শোকাহত নই সবশেষ ফয়সাল আরেফিন দীপনের হত্যাকাণ্ডে, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয়, নীলয় নীল, রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডে।

এই শোকের মিছিল যত দীর্ঘ হবে, আমরা ততো দুর্নিবার হবো, ততো বেহায়া হবো, ততো মুক্তচিন্তক হবো, হত্যাকারীদের ভাষায় ‘ততো ইসলামবিরোধী’ হবো। তখন এই জনস্রোত রোধ করার মতোন শক্তি থাকবে তো কারও?? এখন সময় পাল্টা আঘাত হানার। কেউ সশস্ত্র হয়ে, কেউ কলম ধরে, আঘাত আমাদের করতেই হবে। 

শেয়ার করুন: