দূর দ্বীপ বাসিনী-১

Nodiলিমা রেজওয়ান: আমি জার্মানিতে আছি প্রায় বিশ বছর। এই বিশ বছরে কিছু ভাল অভিজ্ঞতার পাশাপাশি অনেক মন খারাপ করা কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছি। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রবাসীদের অনেক ভাল মন্দ বিষয় আগ্রহ নিয়ে পড়ি। একটি বিষয় যেন অন্তরালেই থেকে যায় সবসময়। বিষয়টি যেন প্রকাশ করাটাই অন্যায়। প্রবাসীরা অনেক রকমের কষ্ট সহ্য করার পর যখন সেটেল হয়ে দেশ থেকে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসেন সেই সব মেয়েরা কেমন থাকেন প্রবাসে? সবাই কি ভাল থাকেন? এমনি কয়েকজনের জীবন কাহিনী নিয়ে খুব ছোট আকারে কিছু লিখব বলে একটি দায় অনুভব করছি—আজ বলব শান্তার কথা। হ্যাঁ ! শান্তা নামটি আমার দেয়া কারন আমি তার সত্যিকারের নামটি এখানে দিতে পারছি না-
শান্তা ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভাল। গল্প, কবিতা, গান, আবৃত্তি এসবে তার দারুণ আগ্রহ। প্রচণ্ড রকমের রবীন্দ্র অনুরাগ। বাবা নেই। শান্তা তার বড় বোনের বাসায় থাকে। জীবনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার।
একদিন বড় বোন শান্তার জন্য পাত্র ঠিক করে। বয়সে একটু বড় হলেও ভাল পরিবার দেখে বিয়েও দিয়ে দেয়। ছেলে জার্মানিতে থাকে। বিদেশে গিয়ে শান্তা নিশ্চয় অনেক ভাল থাকবে। বিয়েটি যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে নিষ্পন্ন হয় পাত্র পক্ষের আগ্রহে।
বিয়ের সাতদিন পর তার স্বামী চলে যায় জার্মানিতে। এরপর সকল প্রক্রিয়া শেষ করে মাত্র সাত দিনের জানাশোনা স্বামীর জন্য একা একাই সে পারি জমায় সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটি দেশে।
অত্যন্ত উন্নত একটি দেশে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রবিহীন খুব ছোট্ট একটি ঘরে শুরু হল শান্তার সংসার জীবন। আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধবহীন প্রবাসে দু একদিন যেতে না যেতেই শান্তা জেনে গেল তার স্বামীটি ভয়ঙ্করভাবে মাদকাসক্ত। আগেও জার্মানিতে একটি বিয়ে করেছিল সে। সেই ঘরেও সন্তান রয়েছে তার। এ যেন আকূল পাথার ! প্রকাশ্যে কান্নাকাটি করার সুযোগও নেই। জীবনের শুরুতেই হোঁচট খেয়েছিল সে বাবাকে হারিয়ে। এবার তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে এসে জীবনের বাকীটুকু আঁচ করতে পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ল শান্তা। বড় বোনকেও সে বলতে পারছে না পাছে সেও কষ্ট পাবে। বেশ ক’দিন অনেক ভেবে চিনতে শান্তা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলো যে যে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে স্বামীকে নেশার ঘোর থেকে ফেরাবে। স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসবে যা ছিল ছিল তার প্রথম ভুল ভাবনা। 
স্বামীকে মানুষ করার প্রচেষ্টার মধ্যেই চলে এলো শান্তার প্রথম সন্তান। ছেলেটি যেন শান্তার জীবনে বেঁচে থাকার একটা বড় অবলম্বন হয়ে এলো। ভাবল এই সন্তানকে মানুষ করার মধ্য দিয়েই সে তার জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে। অন্য কিছু আর কী দরকার ! নিজের জীবনকে এভাবেই হত্যা করেন আমাদের বাঙালি মায়েরা যুগ যুগ ধরে। 
স্বামীকে মানুষ করার পাশাপাশি এবার ছেলেকেও মানুষ করার দায়িত্ব যুক্ত হল। অত্যাচারী স্বামী যখন শান্তার হাতের একটি আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয় তখনও শান্তা যন্ত্রণা লুকিয়ে একগাল হেসে ছেলেকে বলে 
—-চলো বাবা বাইরে থেকে ঘুরে আসি
শান্তা সব সময় চেষ্টা করে স্বামীর এই কুৎসিত চেহারাটি সন্তানের কাছে আড়াল করে রাখতে পাছে ছেলেটি আবার বাবার মত হতে শুরু করে। হায় রে মা ! এভাবে চলতে চলতে জন্ম নিল একটি মেয়ে ও আরো একটি ছেলে। কিন্তু হায় ! দূর্ভাগ্য যেন শান্তার আজন্ম সঙ্গী। এবার জানতে পারল তার সবচেয়ে ছোট ছেলেটি বাক প্রতিবন্ধী। একদম কথা বলতে পারে না। এভাবেই একের পর এক যুদ্ধ যুক্ত হতে থাকে শান্তার জীবনে। 
শান্তা বহুবার এই মানুষরূপী অক্টোপাসের কাছ থেকে মুক্তির কথা ভেবেছে কিন্তু এখানে আসার পর থেকেই তার স্বামী তাকে বাইরের পৃথিবী থেকে যথা সম্ভব আলাদা করে ফেলেছিল। তাকে কোথাও কারো সাথে মিশতে দিত না। তাকে স্থানীয় ভাষা শিখতে দেয়া হয় নি। এ যেন সেই পাখী যার ডানা দুটো ভেঙ্গে অজানা খাঁচায় বন্দী করে দেয়া। যখন অত্যাচারের মাত্রা সকল সীমা ছাড়িয়ে যেত তখন শান্তা দূরে কোথাও চলে যাবার কথা ভাবত। কিন্তু ভাবনা ভাবনাই থেকে যেত তার। এই অবুঝ বাচ্চা তিনটিকে ছেড়ে কোথায় যাবে সে? তাদের নিয়েই বা কার কাছে যাবে ! বড় ছেলেটি যখন ষোল হল তখন সে যেন খানিকটা সাহসী হয়ে উঠল !
আর কত এই বন্দীত্ব ! নীরবে আর কত এই অত্যাচার সহ্য করা ! কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে এবার সে রুখে দাঁড়াতে চাইল এবং অবশেষে তার মাদকাশক্ত, অত্যাচারী স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নিতে প্রশাসনের সাহায্য চাইল। এতো উন্নত একটি দেশ যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি আইন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখে থাকে সেখানে এমন চরম অবহেলি্তা, নির্যাতিতা বন্দী জীবন যাপন করছে সে। প্রশাসন উদ্যোগ নিল তার স্বামীকে বাড়ী থেকে বের করে দেবার। কিন্তু এবার বেঁকে বসল বাচ্চারা। মাকে অনুরোধ করল যেন তাদের বাবাকে বাড়ী থেকে বের করে দেয়া না হয় তাহলে সে নেশা করে এখানে সেখানে পড়ে থাকবে যদিও ওরাও বাবাকে পছন্দ করত না তেমন। এভাবে কাটল আরো দুবছর। অবশেষে সে বিচ্ছেদের মামলা করেছে এবং স্বামী থেকে আলাদা হতে সক্ষম হয়েছে।
কিছুদিন আগে শান্তার সাথে ফোনে কথা বলার সময় ওকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। সে আমার থেকে অনেক দূরের একটি শহরে থাকে তাই ইচ্ছে করলেও শান্তাকে দেখতে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। কাল তার বড় ছেলে ফোন করেছিল। জানালো মাকে নিয়ে সে হাসপাতালে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে তার মা সম্পূর্ণ ভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে——
শেয়ার করুন: