তামান্না কদর: যেখানে মার্কসবাদীরা মনে করছেন, শ্রেণীবিভক্ত সমাজ নারীর দুর্দশার মূল কারণ, সেখানে আমূল নারীবাদ বলছে- না। উদার নারীবাদীরা শনাক্ত করেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারহীনতা নারীর পেছনে পড়ার কারণ। সেখানেও আমূল নারীবাদ বলছে- না। তারা বলছেন, নারীর দুরবস্থার আসল কারণটি জৈবিক।
গর্ভধারণ নারীকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে পুরুষাধীনতা। পরিবার নামক সংগঠনটিও গড়ে উঠেছে জৈবিক কারণেই। পুরুষের আদি ও মৌলিক পীড়নাস্ত্রটি হলো নারীকে শারীরকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় আমুল নারীবাদীরা। তারা শনাক্ত করেছেন মূল লড়াইটা হতে হবে লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে, তারপর পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে।
যেহেতু তারা শনাক্ত করেছেন নারীর দুরবস্থার আসল কারণটি জৈবিক, তাই এজন্যে দরকার মনে করেছেন জৈবিক বিপ্লব। তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে সন্তানধারণ ও পালনের মৌলিক অসাম্য থেকে নারীকে মুক্ত করা সম্ভব এবং করা উচিত বলে মনে করছেন। তারা সোজা বলে দিয়েছেন, মানবপ্রজাতি যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তো সেখানে নারী একা এই দায়িত্ব আর পালন করবে না, করতে হবে পুরুষকেও।
তারা মনে করছেন, জৈবিক পরিবার বিলুপ্ত হলে যৌন পীড়ন লোপ পাবে, তখন কে কার সাথে যৌন সম্পর্ক করবে, সেই স্বাধীনতা থাকবে। তখন আর সমকামিতা নিন্দার কোনো বিষয় হিসেবে পরিগণিত হবে না।
প্রসঙ্গত, উদার নারীবাদীরা মনে করছেন, সমকাম বিষমকামের বিকল্প; মার্কসবাদীরা মনে করছেন সমকাম পুঁজিবাদী বিকৃতি। আমূল নারীবাদের একটি ধারা ‘নারী সমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদ’। এদের মধ্যে কেউ বলছেন-এটা সাময়িক; কেউ বলছেন- সকল সময়ের জন্যে। মোট কথা, পুরুষাধিপত্য বিলুপ্ত করার জন্যে তারা মনে করছেন, নারীর উচিত নয় পুরুষের সাথে কোনো সম্পর্কে আসা।
একথা সত্য যে, পৃথিবীর কোথাও এখনো পর্যন্ত নারীর সম্পূর্ণ মুক্তি ঘটেনি। পুরুষ সকল সময় নারীর বর্তমান কম পেশী শক্তি এবং গর্ভধারণকে পুঁজি করে নারীকে একটি অসহায় অবস্থার মধ্যে রেখে দিয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে। সাম্যবাদী সমাজেও নারীর সম্পূর্ণ মুক্তি ঘটবে বলে মনে হয় না, কারণ সেখানেও লিঙ্গবাদ থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়ে যায়। এখানে সমকাম একটি উল্রেখযোগ্য ভূমিকা নিশ্চয়ই রাখতে পারে। মানুষ মূলত একা-এই উপলব্ধিটি হবার পরও মানুষ একা থাকতে পারে না। প্রায় প্রত্যেক মানুষই চায় তার চিন্তা-চেতনাগুলো অন্য কারো সাথে ভাগ করে নিতে।
একজন সাথীর দরকার হয় তখন। সাথী বলতে, বিশেষত মোটামুটি দীর্ঘস্থায়ী সাথী বলতে যৌন সাথীই বোঝায়। সমাজ এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করে দিয়েছে যেখানে একটি মানুষ সকল সময় তার বিপরীত লিঙ্গের সাথে জোড় বেঁধে বাস করবে যতোদিন মন চায়। সমলিঙ্গ হলেই নিন্দা।
সমলিঙ্গ সাথী হবার সুবিধেটা বেশী, একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে সহজেই। বিশেষত নারীর জন্যে সমকামী হওয়া অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দ্যের, নিজেকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা সম্ভব। পুরুষ সকল সময় নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সে চায় তার বাচ্চা হবে, নারীটিকেই যেহেতু সে বাচ্চা উৎপাদন করতে হচ্ছে, তাই পুরুষটি তার নারীসঙ্গীকে পীড়নের একটি সুযোগ পায়।
সমকামে বাচ্চা উৎপাদনের ব্যাপার-স্যাপার নেই। শোষিত বা পীড়িত হবারও সুযোগ নেই। তবে আফসোসের বিষয় চাইলেই কেউ সমকামী হতে পারে না, এটা নিজের ভেতর থাকতে হয়। আবার থাকলেও পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা এবং একাডেমিক শিক্ষার বদৌলতে নিজের অজান্তেই সমকামিতার প্রতি একধরনের অনীহা বা ঘৃণা তৈরি হয়, মনের অজান্তেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
এখন কেউ হয়তো সমকামকে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ বলছেন-যা আসলে প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। আর সকল সময় কি আমরা প্রকৃতি নিয়েই বসে থাকি? তো লিঙ্গবাদীরাও তো পুরুষ দ্বারা নারীকে নিয়ন্ত্রণ বা পীড়নকে প্রকৃতির দোহাই দিয়েই বৈধ করতে সচেষ্ট থাকে সকল সময়, নারীবাদীরা কি সেটা মেনে নিয়েছে, নাকি নেবে?
আরেকটি বিষয় হতে পারে, যেসব নারী সমলিঙ্গের প্রতি যৌনাকর্ষণ অনুভব করেন না, আবার পুরুষাধিপত্যও মেনে নিতে চান না, তারাও যৌথ জীবন যাপন করতে পারেন অন্য কোনো নারীর সাথে। জীবন কেবলই যৌনতা নয়, আবার যৌনতা বাদ দেয়ারও বিষয় নয়।
চিন্তা-চেতনা, সুখ-অসুখ এসব ভাগ করে নেয়ার জন্যে নারীর বিকল্প শুধু নারীই। এক্ষেত্রে যৌনতা উপভোগ করতে পারে দুজন নারীই বাইরের পুরুষের সাথে। শুধু যৌনতার জন্যেই একসাথে থাকা কোনো সৃজনশীল মানুষের কাজ নয়।
পুরুষরা বিদ্রোহ করবে নারীর বিরুদ্ধে-এ বিষয়টি মাথায় আনবার কোনো দরকারই নেই। পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে সে সম্পূর্ণ অক্ষম। পুরষ বিদ্রোহ করতে পারে নারীর বিরুদ্ধে, নিজের যৌনতার বিরুদ্ধে নয়, তার ভালো প্রমাণ পতিতালয় ব্যবস্থা, নিজের স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও নিজের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণে ভীষণ অক্ষম, আর তাই যৌনকর্মীদের কাছে যাওয়ার বিষয়টিতে সে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।
মানবজাতি ধ্বংসের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে?
বেশ তো হয়ে যাক না। যে প্রজাতিতে ৫০% ভাগ মানুষ অন্য, আর ৫০% ভাগ মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হয়, নির্যাতিত হয়, শোষণের শিকার হয়, সে প্রজাতি থাকার দরকার কী? নারীর অতো কী দায় পড়েছে যে মানবজাতি রক্ষার দায় নেবে নিজেকে নিপীড়িত হতে দিয়ে?