হিজাব- বোরকা-ওড়না আসলেই কি ফ্যাক্টর?

Prova
মারজিয়া প্রভা

মারজিয়া প্রভা: Womenchapter এর এডিটর সুপ্রীতি ধরকে হত্যার হুমকি দিয়েছে একটা গ্রুপ। তাদের গোস্বার কারণ, এই পোর্টালে হিজাব-বোরকা-ওড়না বিরোধিতা করে লেখা প্রকাশ করা হয়।

“আমাদের ওড়না-জীবন” নামে শীর্ষক একটি আর্টিকেল এই পোর্টালেই প্রকাশ হবার পর, সেই এক টাইপের প্যানপ্যান শুনতে হয়েছে “ আমি নারীদের শালীনতাকে হেয় করছি।“ দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, কতিপয় মেয়ে আমাকে যা তা বলেছে। তারা কেন জানি মনে করেছে, আমি তাদের ওড়না ছেড়ে ঘুরতে বলেছি।

আসলে কি লেখাটা সে উদ্দেশ্যে ছিল? আমার মূল কনসেপ্ট তো ছিল, কোন মেয়ে ওড়না পড়ে কি না পড়ে সেটা সম্পূর্ণ তার বিষয়, আমাদের আশপাশের মানুষ তা নিয়ে বলার কোন অধিকার রাখে না, ওড়নার মতো সামান্য বস্ত্র নিয়ে কোন মেয়ের চরিত্র নির্ধারণ কিছুতেই হতে পারে না!

আমার  কতিপয় শিক্ষিত(!) পুরুষসমাজ নারীর শালীনতা কিংবা ইজ্জত “গেল গেল” বলে আমাকে গালাগালি পাড়লো। প্রথমেই বলছি, আমার এগুলো গায়ে লাগে না। আবাল পুরুষদের কথা গায়ে লাগানোর মত আবাল আমি এখনও হইনি।

সো-কলড শালীনতা বা ইজ্জত বলতে আমরা কি বুঝি? শালীনতা একটা টার্ম, যা স্থান ভেদে মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়। শালীনতা মানে নিপাট সৌন্দর্য। শালীনতা হচ্ছে সেই জিনিষ যা আপনার ব্যক্তিত্ব তুলে ধরবে। শুধুমাত্র আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে শালীনতা মানে পুরুষের লোভী দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য শত প্রচেষ্টা। আমাদের দেশের কোন মেয়েকে আমি বিকিনি পড়ে রাস্তায় ঘুরতে দেখিনি, তারা ধর্মমতে “ইজ্জত স্থান যথেষ্ট হেফাজতে রাখে”। তারপরেও আমাদের দেশের লোক কেন ঠিক, এই শালীনতা, হিজাব –বোরকা নিয়ে এতো কথা বলে ?

এই প্রসঙ্গে সচলায়তন ব্লগের একটা লেখার কথা মনে পড়ছে। অ্যাডামের মাথা অলওয়েজ ঘুরান্টি দেয়, ইভের পোশাক নিয়ে। ঈশ্বর ইভের পোশাক ঠিক করতে করতে তাকে শেষ পর্যন্ত সিন্দুকের বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে। তাও অ্যাডামের তর শোয় না, সে বলে “ ওই সিন্দুকটাও মনহর বড়”। পুরো লেখা এই লিংকে (http://www.sachalayatan.com/node/41918 )।

আমি অনেক পুরুষকে দেখেছি, বোন শার্ট প্যান্ট পরছে। তাকে নিরাপদে আগলিয়ে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। সেই লোকই রাস্তায় এক মেয়ের ওড়না বাতাসে উড়ে গেলে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরছে “ ওই ত্তেরি সাইজ কি ৩৬ না ৩৮”। এটার মানে কি? যে দৃষ্টিতে আপনি বোনের দিকে তাকাচ্ছেন তাতে মাংসের লোভ ছিল না, অন্য মেয়ের জায়গা সেখানে মাংস চলে এলো? এটা কি পোশাকের দোষ না আপনার দৃষ্টিভঙ্গি?

ওই যে হিজাব-বোরকা- ওড়না বলছেন না? আপনি কি ওড়নার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেহ দেখতে চান না ! চান তো! ব্যাপারটা কি এরকম মেয়ে ওড়না ছাড়া বেড়িয়েছে বলে আপনি দেখছেন? নাকি দেখবেন বলেই তাকাচ্ছেন!

কে জানি একজন বলল, ওড়না ছাড়া থাকলে দুরাচার পুরুষরা দৃষ্টি দিবে! সেটা ওড়না ছেড়ে থাকার দোষ না দুরাচার দৃষ্টির দোষ?

আবালের আরও কথা আছে, বাইরে মূল্যবান বস্তু ফেলে রাখলে কি চোর নিবে না? প্রসঙ্গ হচ্ছে, চোরদের ধর্মই চুরি করা, আমার মূল্যবান বস্তু ফেলে রেখেছি বা রাখেনি তাতে কিচ্ছু যায় আসে না !

সেদিন ফারজানা কবির খানের ফেবুতে শেয়ার করা বার্লিনের উৎসব কার্নিভ্যাল অফ কালচারের একটা ফটো দেখলাম। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে নিজেদের পছন্দমতো পোশাকে আনন্দ করে যাচ্ছে। ওই কেস আমাদের এখানে হলে, কিছু ছেলে হাত মারতো! কিছু ছেলে রেগুলেটর সামলাতে না পেরে নারীকে রেপ করত।

আপনি কি ভাবছেন, ওই মেয়েগুলো বার্লিনের মেয়ে বলে গায়ে হাত দেওয়া যাবে? একটু হাত দিয়ে দেখবেন, পুলিশ এসে সটান করে জেলে পুরে দিবে।  বেশ কিছুদিন আগে একজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম, আমাদের বঙ্গদেশীয় এক সন্তান, রেগুলেটর সামলানো শিখেনি বলে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে এক মেয়েকে ওরকম হ্যারাসমেন্ট করতে গিয়েছিল, মেয়ে মার্শাল আর্ট জানত, সোজা ধরে কুপোকাত, এর মধ্যে পুলিশ এসে জেলে ভরে দিয়েছিল!

মেয়ে মানে মাংস না, সেক্স সিম্বল না! যেদিন থেকে এই কথা সবাই বিশ্বাস করতে পারবে, সেদিন ওসব পোশাক নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা থাকবে না। কে ওড়না গলায় পরলো, কে পরলোই না, আবার কে মাথাশুদ্ধ গায়ে জড়ালো, আমাদের দেখবার বিষয় থাকবেই না।

যে মেয়েরা আমার লেখার বিরোধিতা করেছে, তাদের প্রতি আমার sympathy  ছাড়া কিছু নেই। পুরুষদের চোখ এড়িয়ে থাকার তপস্যা করতে গিয়ে, এরা সামান্য লেখার অনেক মিনিং করে। এরা ভাবে বুক থেকে ওড়না খসলেই সতীত্ব যাবে।

কে ওড়না পরবে, হিজাব করবে তার ব্যাপার! কে করবে না সেটাও তার ব্যাপার! এই নিয়ে কোন কথা কখনও হবে না, যে পরতে চাইবে না তাকে জোর করে পরানোর কোনো মানে নেই। যেমন আমাকে জোর করে ওড়না ধরানো হয়েছিল, আমি সেটার বিরোধিতা করি।

সুপ্রীতি আপুকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষ করবো আপুর কথা ধরেই। আপুকে যারা থ্রেট দিচ্ছে পোশাক নিয়ে এইসব লেখা ছাপাচ্ছে বলে তাদের প্রতি কিছু কথা। মেয়েদের কি যৌন অনুভূতি নেই? কোন সুবেশী ছেলে শার্টের বোতাম খুলে যদি যায়, তার লোমশ বুক দেখে মেয়েদের জাগ্রত অনুভূতি হয় না? মেয়েরা কি কখনও বলে তার শার্টের বোতাম লাগাতে? তাহলে একটা ছেলের কেন অধিকার থাকবে মেয়েদের পোশাক নিয়ে কথা বলার? মেয়ে কি ইচ্ছে করলে পারে না, ছেলেদের শরীর ধরতে? তাহলে একটা মেয়ে কেন সেটা করে না?

মেয়েদের কন্ট্রোল ক্ষমতা অনেক, এটা ভুল! মেয়েরা কন্ট্রোল করে, আমাদের দেশের মেয়েরা একটু বেশীই অবশ্য করে সমাজের চাপে পড়ে! মেয়েদের ওড়না গলায় উঠলে যদি রেগুলেটর কন্ট্রোল না করতে পারেন, আপনি কি তাহলে অসভ্য জানোয়ার? ক্ষুধার্ত নেকড়ে যেমন মাংস পেলেই খায়, আপনিও কি মেয়েদের শরীর পেলে খেতে থাকেন চোখ দিয়ে?  তাহলে বলছি, মেয়েদের ইজ্জত, শালীনতা নিয়ে কথা বলা আসলে আপনাদের মানায় না!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.