তামান্না ইসলাম: অনেকেরই ধারণা যে আমেরিকা, কানাডা এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে নারী পুরুষ কোন বিভেদ নাই এবং নারীরা সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করছে। তারা শুনলে অবাক হবে যে, আমেরিকায় গড়ে একই যোগ্যতা সম্পন্ন মেয়েদের বেতন ছেলেদের চেয়ে কম। মেয়েদের চাকরী পাওয়া এবং উপরে উঠার ক্ষেত্রে এসব দেশেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। সমস্যার ধরনটা হয়তো কিছুটা আলাদা, এই যা।
নিজের কিছু অভিজ্ঞতার গল্প বলি,
বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমি বসে আছি এক চৈনিক ভদ্রলোকের মুখোমুখি। তিনি আমাকে ইন্টারভিউ করছেন। ততদিনে আমি কাজে বেশ অভিজ্ঞ, কিন্তু আমার নেগেটিভ সাইড হলো আমি দুই বাচ্চার মা, তার উপরে ছোটটার বয়স আড়াই বছর। দুই চারটা টেকনিক্যাল প্রশ্নের পরই শুরু হলো ওয়াজ নসিহত, “এই কোম্পানিতে কিন্তু অনেক কাজ, তুমি জুনিয়রও না, তুমি কি নিশ্চিত যে এত ছোট দুইটা বাচ্চা নিয়ে তুমি ঠিক ঠাক মত কাজ করতে পারবে?”
“আমি পারি কারণ আমার বউ বাসায় থাকে, আমি দিন রাত কাজ করতে পারি”। আমি খুব বেশি কিছু না বলে বললাম, “আমি নিশ্চিত আমি খুব ভালো মত পারব, এর চেয়েও কঠিন সময় আমি এই ছোট বাচ্চা সহই পার করে এসেছি।”
আমার মনের জোর দেখে, নাকি ইন্টারভিউ টিম এর অন্যদের কথায় জানি না চাকরিটা আমার হয়ে গেল। এবং খুব অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই চৈনিক এর সুরও পাল্টে গেল “তোমার আমার মত লোক না থাকলে টিম এর কি দশা হবে বল তো?” ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম “এই তুমিই না সেদিন আমাকে দুই বাচ্চার মা বলে অযোগ্য ঘোষণা করতে যাচ্ছিলে। কতো ভয় দেখালে। “
প্রথম প্রথম মিটিংগুলোতে গিয়ে ঘাবড়ে যেতাম। বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না অবস্থা। তার পরে সাহস করে যখন মুখ খোলা শুরু করলাম, দেখি কেউ আমার কথায় কর্ণপাত করতে রাজি না। বিশেষ করে কিছু ঘাগু এবং অভিজ্ঞ লোক, দুঃখজনকভাবে তারা একেবারেই পাত্তা দিতে রাজি না। এমন একটা ভাব যেন আমার কথা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। আমার কোন অস্তিত্বই নাই। ভীষণ কষ্ট হত।
উপায় না দেখে একবার নারীদের সমস্যা নিয়ে এক মিটিং এ জিজ্ঞ্যেস করলাম, আমার কী করা উচিত। আমাকে বুদ্ধি দেওয়া হলো দরকার হলে দাঁড়িয়ে যেতে। একবার ভাবুন, এই কথা শুনলে, আমাকে প্রতি মিনিটে উঠ-বস স্টাইল এ দাঁড়াতে এবং বসতে হবে।
অনেক ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলাম, অনেক সাহস করে যারা মিটিং চালায় বা প্রধান বক্তা, গিয়ে সরাসরি তাদের মুখোমুখি চেয়ারটা দখল করতাম। সাথে সাথে কাজ দিল। চোখের অনেক ক্ষমতা। একজন সরাসরি আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন, সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করা সহজ কাজ না। এই বার আমি মোটামুটি মনের সুখে আমার মতো করে আলাপ আলোচনা চালাতে পারছি।
কিন্তু দেখা দিলো আরেক সমস্যা, আমি হয়ে গেলাম তাদের নজরবন্দী। হাজার হলেও বাঙালি মেয়ে, মাঝে মাঝে আজব সব সন্দেহ এসে দেখা দিত মনের ভিতরে, আজকে উদ্ভট কোনো কাপড় পরে আসি নাই তো, জামা-কাপড় ঠিকঠাক আছে তো, বেশি সেজে এসেছি নাকি কিংবা এই ব্যাটার অন্য কোনো মতলব নাই তো। তারও অনেক পরে যখন নিজেই অনেক মিটিং চালানো শুরু করলাম তখন ভুলটা ভাঙ্গলো, আসলে যে কোনো মনোযোগী শ্রোতা পেলেই বক্তারা তাকে আঁকড়ে ধরে, খুব বেশি মানুষ মিটিং এ সব সময় মনোযোগ দেয় না, কাউকে না কাউকে তো কথা শোনাতেই হবে, যত বেশি অংশগ্রহণ করা যায়, মিটিংয়ের সাফল্য তত বেশি। তাছাড়া, কারো মনে কোন মতলব থাকলে তাকে পাত্তা দেওয়ার কোন দরকার নাই, দাপটের সাথে এই সব ভীতু মানুষদের উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে হয়।
চাকরিতে যখন আরেক ধাপ এগিয়ে গেছি, তখন এর চেয়েও উদ্ভট এক সমস্যার মুখোমুখি হলাম। আমি একটি নতুন টিমে বদলি হয়েছি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সেই টিমের ম্যানেজার চলে যাচ্ছে, সে আমাকে তার দায়িত্ব দিয়ে যেতে চায়। বাদ সাধলো তার ম্যানেজার। কারণ সেই টিমের সবচেয়ে দক্ষ যে ছেলেটি সে মেয়ে ম্যানেজারের অধীনে কাজ করতে রাজী না, মেয়েদের উপরে তার আস্থা কম। জীবনে কখনো শুনি নাই যে অধস্তনদের মতামতের উপরে নির্ভর করে ঊর্ধ্বতনের নিয়োগ। পুরোপুরি আমেরিকান সেই ম্যানেজার আমাকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দিল সেই ছেলেকে খুশী রাখতে। সেই ছেলে যখন আমার কর্ম দক্ষতায় খুশি, শুধুমাত্র তারপরেই আমার পদ পাকাপাকি হলো।
এই আমেরিকান ম্যানেজারকেই দেখেছি টিমের অন্য লোকদের সাথে বন্ধু হয়ে যেতে। একসাথে আড্ডা দিতে, রসিকতা করতে। শুধুমাত্র লিঙ্গ ভেদের কারণে আমার সাথে কোন দিন তার সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়নি। এবং, স্বাভাবিকভাবেই তার সেই বন্ধু সুলভ অধীনস্থরা তার কাছ থেকে বেশী সুযোগ সুবিধা পেতো।
এ ব্যাপারে হতাশ হয়ে একদিন অভিযোগ করেছিলাম তার কাছে সরাসরি, উত্তর আসলো, মেয়েদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা বিপদজনক, কারণ সেটাকে ফ্লার্ট হিসাবে ভুল ভাবার সম্ভাবনা থাকে।
এভাবে প্রতি পদে পদে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে। যেদিন উপরের দিকে পদে নারী পুরুষের সংখ্যা সমান সমান হয়ে যাবে, সেদিন হয়তো আর এগুলো থাকবে না। ততদিন পর্যন্ত একলা চল রে।
কি ভীষন ভালো লেখা। আগে কেন পড়া হয়নি ? মনে হয় ঠিক মতো দেখা হয়নি । অনেক শুভ কামনা আপনার জন্যা। আসলে একলা চলতে চলতে কখন যেন একলা চলা অভ্যাস এ পরিনত হয়ে গেছে। ভালো থাকবেন।