কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া দেখেন বাদশাহ-
শাহজাদা এক পাত্র হস্তে
নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া
নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি
অঙ্গুলি।”
কাজী কাদির নেওয়াজের পুরো কবিতাটি না বললেও আমাদের দেশে এখন পুরো উল্টা কবিতা চলছে। শিক্ষকই এখন ছাত্রের পায়ে ধরে ধরে নিজের জান বাঁচাচ্ছেন। একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে, সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনসহ মন্ত্রি-এমপির রোষানলে পড়েছেন শিক্ষক। সমাজ নির্মাণের কারিগরদের লাঞ্ছিত হতে হয় তার ছাত্রের হাতে। সেই সাথে বুট ও বন্দুকের আঘাত তাকে পাঠায় হাসপাতালে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ইসলাম ধর্মে শিক্ষকের মর্যাদা মা-বাবার পরে। হিন্দু ধর্মে মা-বাবার আগে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকৃত শিক্ষকের স্থান কোথায়? যে শিক্ষকরা কোন দলের সাথে যুক্ত নন, কোন সুবিধার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে পিছনে ঘোরেন না। যারা ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করাই একমাত্র ধর্ম বলে মনে করেন, তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান কোথায়? যখন যে দল বিরোধী দলে থাকে সেই দল সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষকদের বেতন, বকেয়া প্রদানসহ বিভিন্ন সুবিধাদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলে টানেন ভোট ব্যাংক হিসেবে। কিন্তু আসলেই কি তারা কোন সুবিধা পায়? ক্ষমতায় এসেই ভুলে জান সব ওয়াদা
দিন বদলের প্রতিশ্রুতি, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসে কি দিলেন জাতিকে? নতুন স্বপ্ন যে দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু সেই বদল কোন দিকে যাচ্ছে? চারদিকে অনিয়ম, অত্যাচার, মিথ্যা আর দুর্নীতির দিকে।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার চারপাশে কি ঘটছে আপনি কি দেখেন না, না আপনাকে দেখতে দেয়া হয় না? আপনাকে কি সব কিছু ভাল আর সুষ্ঠভাবে চলছে বুঝিয়ে রাখা হয়? ডিজিটাল যুগে আপনি কি আপনার মুঠো ফোনেও দেখে নিতে পারেন দেশের প্রকৃত হাল। নাকি আপনার চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষ গুলোর চোখে আপনি দেখেন, ওরা যা দেখায় যা বোঝায় তাই আপনি দেখেন আর বোঝেন। তাহলে আর আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যা হয়ে কি করলেন?
আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন না, সমাজ নির্মাতারা কতটা অবহেলিত। কত অপমান সইছে শুধু মাত্র দেশকে ভালবেসে নিরলস পরিশ্রম করে। যাদের কাছে বিদ্যাদান একমাত্র ধ্যানজ্ঞান তাঁদের হেয় করে চলেছে একদল, অশিক্ষিত সুবিধাবাদী নেতা-কর্মী, যারা আপনার আওয়ামী সরকারের ধারক-বাহক।
দলের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ যেখানে জরুরী, সেখানে ডক্টর জাফর ইকবালের বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। আপনি জানেন ড. জাফর ইকবাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৫ সালে অনার্স-এ দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]। তিনি ১৯৮২ তে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি সম্পন্ন করে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সাফল্যের সাথে ডক্টরেটোত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন। ১৯৮৮ তে তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) এ গবেষক হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। তিনি একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মনোনীত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ২৪ ঘন্টা আগেও, কিন্তু পদত্যাগ করলেন।
কেন তিনি পদত্যাগ করলেন ??? দেশের প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা, মুঠো ফোনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ডক্টর জাফর ইকবালের হাত ধরে শাবিপ্রবি তে। প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর না পেরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে অন্যান্য অনেকের যেমন অবদান রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে জাফর স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম। সেই শিক্ষক যে বিদেশের আমার আয়েস, বিত্ত-বৈভব, নিরাপদ সম্মানীত জীবন ছেড়ে কেন চলে এসেছিলেন দেশে? শুধুমাত্র দেশ কে দেশের মানুষ কে ভালবাসার কারনে। নিজের সবটুকু মেধা বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দেশের ভবিষ্যতদেরকে, আগামী কাণ্ডারিদের।
বিনিময়ে তিনি কি পেলেন?
স্যার কে শুনতে হলো ‘জনসম্মুখে চাবুকের বাড়ি’ খাওয়ার কথা। সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে তিনি ডক্টর মোহম্মদ জাফর ইকবালকে জনসম্মুখে চাবুক মারতেন।
এমপি মাহবুব সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছাড়িয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘জাফর ইকবাল, সে হল এক লক্ষ পারসেন্ট গৌরগোবিন্দ, সে চায়না সিলেটের মানুষ শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হোক। এখানে যে ভিসি ছিল তাকেও দিয়েছে তাড়িয়ে। আর এই সিলেটের মানুষ তাকে ফুলচন্দন নিয়ে সুন্দর সুন্দর ফুল নিয়ে প্রত্যেক দিন মূর্তিপূজা করতে যায়। আমি যদি বড় কিছু হতাম তাকে ধরে চাবুক মারতাম কোর্ট পয়েন্টে এনে!’
ড. জাফর ইকবালকে এসব কথা শুনতে হয়েছে, কারণ তিনি মত দিয়েছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় কখনো শুধু একটি অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হতে পারে না। সিলেটিদের জন্য শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা কোটার বিরুদ্ধে তিনি লেখালেখি করেছেন। তিনি ছাত্রদের কল্যাণের কথা ভেবেছেন বলে।
সিলেটের এই এমপির কথার মাঝেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি। গত শনিবার সিলেট আওয়ামী লীগ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে এবং তাঁকে ব্লগার বলে সম্বোধন করে একটা শ্রেণিতে ফেলার ঘৃণ্য প্রয়াস চালাচ্ছে। কেউ ব্লগার হলে সে কি খারাপ? ‘গৌরগোবিন্দ’, ‘মূর্তি পুজার’ মতো শব্দ ব্যবহার করে সিলেটের এমপি যে চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেছেন, তা জঙ্গি সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করবে।
একজন সংসদ সদস্যের কাছ থেকে এমন নিম্নরুচির ব্যবহার প্রত্যাশিত নয়। এতে উনার শিক্ষাহীন আর নৈতিক দৈন্য চেহারাই ফুটে উঠে।
প্রাইমারী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও আমাদের দেশের শিক্ষক মর্যাদা পান না, একদল দলবাজী সুবিধাবাদী শিক্ষকদের, পদ-অর্থ-ক্ষমতা লোভের কারণে প্রকৃত শিক্ষকের আজ এই অসম্মানজনক অবস্থা। তাই দেখে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের কথা মনে পড়ে।
গল্পের শেষাংশে পণ্ডিত মশাই তার ছাত্রদের প্রশ্ন করেনঃ
”আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আমরা আটজনা।’
লাট সায়েবের তিন ঠ্যাঙা কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?’
আমি ভয় করছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’
তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?”
এবার আপনার কাছে প্রশ্নঃ আমাদের আদর্শবাদী, নীতিবান ও সৎ শিক্ষকের মূল্যায়ন কয়টা অশিক্ষিত, দুর্নীতিবাজ এমপি-মন্ত্রীর ও ছাত্রনেতার কয় ঠ্যাঙের সমান?
লেখক ও সাংবাদিক।