
তুষার কান্তি সরকার: একজন কুখ্যাত রাজাকারের প্রতি মানুষের কতটা ঘৃণা থাকলেই একজন শান্ত-স্নিগ্ধ মানুষের এতোটা রাগ-ক্ষোভ জাগতে পারে, তা চোখে না দেখলে কখনও বিশ্বাসই করতাম না।
গত রোববার বিকেলে হেলসিংকি থেকে ভাইকিং লাইন এর বিশাল জাহাজে করে সুইডেন এর রাজধানী স্টকহোম শহরে মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য বেড়াতে গিয়ে এমন এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এলাম। এই রকম দিন জীবনে আর কোনদিন আসবে কিনা জানি না।
চিত্রা পাল, দীর্ঘদিন ধরে সুইডেনে আছেন, যাঁকে আমি বড় দিদির মত শ্রদ্ধা করি, তিনি এসেছিলেন জাহাজঘাটে আমাকে উনার বাড়ী নিয়ে যাবার জন্যে। উনার সাথে বহুবার টেলিফোন এবং স্কাইপে কথা হলেও এটাই ছিলো আমাদের প্রথম সামনাসামনি দেখা। যদিও আগে থেকেই উনাকে একজন সহজ-সরল মানুষ হিসেবে জানতাম, সব সময় যাকে দেখতাম একটা প্রাণখোলা হাসি নিয়ে কথা বলতে, তাঁকে কখনো এতটা ঠান্ডা মাথায় এতো শক্ত করে কথা বলতে দেখবো, সেটা কখনই ভাবিনি। কিন্তু আজ সেটাই দেখলাম।
আমি আর চিত্রাদি একটা বাস স্টপেজের কাছে দাঁড়িয়ে দাদাবাবুর (চিত্রাদির বর) জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। একসময় হঠাৎ চিত্রাদি বললেন, আসেন এই রাজাকারটাকে দুইটা কথা শুনিয়ে আসি।
আমি ভাবলাম, হয়ত উনার কোনো ঘনিষ্ট বন্ধুকে অনেকদিন পর সেখানে দেখেছেন এবং একটু মজা করেই হয়তো একথা বলছেন। কিন্তু মূহূর্তেই পুরো দৃশ্য অন্যরকম হয়ে গেল।
তিনি ট্রেন স্টেশন এর দরজার সামনে দাঁড়ানো এক দাড়িওয়ালা বাংলাদেশী বয়স্ক লোকের কাছে এসে দাঁড়ালেন। লোকটা ততক্ষণে কাঁচু-মাচু হয়ে দিদিকে হাত তুলে গ্রীট করে জিজ্ঞ্যেস করলো, ‘ভালো আছেন’?
দিদি জবাবে বললেন, ‘আপনাকে দেখে ঘেন্নায় আমার শরীর ঘিন ঘিন করছে। ‘৭১ এ এতো এতো হিন্দুদের আপনি যেভাবে খুন করেছেন, যেভাবে ওই সময় আপনি মেয়েদের মান-ইজ্জত নষ্ট করেছেন, আর হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করেছেন, আর এখন আমাকে জিজ্ঞ্যেস করছেন, কেমন আছেন?
লোকটা এমন এক আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না তখন। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্যে তার শেষ চেষ্টা হিসেবে জোড় হাত করে বললো, ‘আমি খোদার নামে কসম খেয়ে বলছি ‘৭১ এ আমি একটা হিন্দুকেও খুন করিনি’।
চিত্রাদি রেগে গিয়ে বললেন, ‘আবার মিথ্যা কথা বলেন, এই মূহূর্তে আপনার মুখের উপর যদি আমি আমার সবটা থুতু দিতে পারতাম তাহলে আমার প্রাণটা শান্তি পেতো’।
লোকটা তখন চুপ হয়ে চিত্রাদির ধমক খাচ্ছে, আর ধীরে ধীরে সেই জায়গা থেকে সরে যেতে শুরু করে।
চিত্রাদি তখনো বলে যাচ্ছেন, ‘ব্যাটা রাজাকার এই দেশে এসে আমার ট্যাক্স এর টাকায় খায় তো খায়ই আবার সারাদিন মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। আমাদের ট্যাক্স এর টাকায় দুইজন গার্ড নিয়ে চলে সব সময়’।
আশপাশের কয়েকজন লোক এই দৃশ্য দেখছিলেন, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে এগিয়ে আসেননি। শেষে চিত্রাদি লোকটাকে বেশ কয়েকবার ‘ক্রিমিনাল’ ‘ক্রিমিনাল’ বলে চিৎকার করার পর আমার অনুরোধে শান্ত হন।
জীবনে এই প্রথম আমি দেখলাম একজন দাগী-অপরাধী কিভাবে তার অপরাধের কথা শুনে চুপ করে সেই জায়গা থেকে সরে যায়। এবার চিত্রাদি আমাকে জানালেন, এই সেই কুখ্যাত খোকন রাজাকার। তারপর সেই রাজাকারের গল্প শুনতে শুনতেই দাদাবাবু চলে এলেন ,আর আমরাও উঠে গেলাম দাদাবাবুর গাড়িতে।
চিত্রাদি জানান, ১৯৭১ এ তাঁর পরিবার কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিভাবে তাঁর আপন মামাকে তাঁদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকার আর পাকবাহিনী মিলে। সেই মামার কোনো খোঁজ মেলেনি আজও। অথচ চিত্রাদির মামী বছরের পর বছর অপেক্ষায় থেকেছেন মামা ফিরে আসবেন বলে। কিন্তু মামা আর ফিরে আসেননি। সেই কষ্টই বয়ে বেড়াচ্ছেন চিত্রাদি এবং তাঁর পরিবার। এই চিত্রাদির মা সন্তানদের কৃতিত্বের জন্যে রত্নগর্ভা উপাধি পেয়েছিলেন বেশ কবছর আগে। সেই রত্নগর্ভা মায়ের এই মেয়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দৃশ্য নিজ চোখে দেখে মনে হচ্ছে, যোগ্য মায়ের যোগ্য অগ্নিকন্যাই বটে!
খোকন রাজাকার কোনদিন তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে কিনা জানি না, তবে চোখের সামনে তাকে এমন নাজেহাল হতে দেখে মনে মনে শান্তি পেলাম।