সহিংস পরিবেশে শিশুরা আতংকিত,আস্থাহীন ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠে  

Primary Eduমাহফুজা জেসমিন: দেশের  বুদ্ধিজীবী,  চিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এই পরিস্থিতি শিশুদের কেবল শৈশব এবং কৈশোরকেই নষ্ট করছে না, তাদের ভবিষ্যত চিন্তা, আদর্শ ও মূল্যবোধকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, চলমান পরিস্থিতি শিশু-কিশোরদের ভয়াবহ ক্ষতি করছে। এটি তাদের বর্তমানকে আতংকগ্রস্ত করছে। পেট্রোল বোমার আগুন কেড়ে নিচেছ কচি প্রাণ। নষ্ট হচ্ছে তাদের স্বপ্ন। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাদেও কৈশোরের কোমল অনুভূতি। এরকম অস্থির সামাজিক পরিবেশে মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।

জাতীয় শিশু দিবসের প্রাক্কালে তিনি শিশুদের জন্য একটি সুন্দর,সুস্থ ও মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “এরকম সহিংস পরিবেশের মধ্যে বড় হওয়া শিশুরা আর যাই হোক, সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। সমাজে বড়দের কাছ থেকে তারা যে মূলবোধহীনতার শিক্ষা পাচ্ছে সেজন্য তারা বড়দের প্রতিও শ্রদ্ধা হারাবে।”

শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুদের অনিশ্চয়তা শিশু-কিশোরদের মনে যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে তাতে তারা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাবে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এই বরেণ্য কথা সাহিত্যিক।

গাজীপুরে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ  ছ ছয় বছরের শিশু মরিয়ম বেগম রূপা টানা ৩৫ দিন ৪৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে না ফেরার দেশে চলে গেছে । নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় যাত্রীবাহী বাসে  পেট্রোল বোমা হামলায় গুরুতর দগ্ধ  আড়াই বছরের শিশু সাফির এক পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে করুণ চোখে চেয়ে দেখে সবার আসা যাওয়া। ইচ্ছে থাকলেও সাফির আর খেলতে পারে না। দৌড়ে ঘরের এ প্রান্ত ও প্রান্ত করতে পারে না। তার স্বাভাবিক জীবনের আশায় দিন গুনছে পরিবার।

সুন্দরগঞ্জের সীচা পাঁচপীর থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় ২ শিশুসহ ৮ নারী-পুরুষ দগ্ধ হয়ে মারা যান। গুরুতর আহত হন শিশুসহ  আরো ৩২ জন। সিলেট নগরীতে ককটেল হামলায় গুরুতর আহত হন সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জের  দুধের শিশু হাফিজুর রহমান এবং ৮ বছরের আফ্রিতা ।

গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধের সমর্থনে চলছে বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ-এর মতো সহিংসতা। চলছে মানুষ হত্যা। জীবন দিচ্ছেন তাজা তরুণ প্রাণ। কেউ ফেলে যাচ্ছেন পরিবার ও সন্তান। কেউ আবার শিশু সন্তানের দগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠছেন। দগ্ধ নারীদের নারী জীবনের নানা সমস্যার মধ্যে যুক্ত হচ্ছে নতুন সমস্যা।

রাজনীতির এই বিভীষিকা কেড়ে নিচ্ছে  জীবন ও স্বপ্ন। শিশুর শিক্ষা ও  শৈশব। মানুষের  স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার। সর্বোপরি এর শিকার হচ্ছেন সমাজের নারী ও শিশু।

আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারি মাসে এক প্রতিবেদনে বলেছে,  যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও অন্যান্য সহিংসতায়  এবছরের ৫ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ জন শিশু প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে আরো ১২ জন।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৬ দিনে সারাদেশে ৭৩ জন শিশু রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছে ১৪ শিশু এবং দগ্ধ হয়েছে আরও ২১ জন। অন্যদিকে ককটেল হামলায় নিহত হয়েছে আরও দুই শিশু। ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছে আরও ১৩ শিশু। সব মিলিয়ে ককটেল আর পেট্রোল বোমা হামলায় প্রাণ গেছে ১৬ শিশুর।

এছাড়াও  ৫ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত  রংপুর-গাইবান্ধা জেলায় ২টি যাত্রীবাহী বাসে ও একটি ট্রাকে দুর্বৃত্তদের পেট্রলবোমা হামলায় মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন ৫ নারী, ৫ শিশুসহ ১৫ জন। আর আহত হয়েছেন ৫১ জন। আহতদের মধ্যে ২৯ জনই নারী ও শিশু।

পত্রপত্রিকায় এসব পরিসংখ্যান প্রকাশের পরেও ডিএমসিএইচ-এর বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে দুই শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সব তথ্য সন্নিবেশিত করা না গেলেও এই সংখ্যা বেড়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসিএইচ) বার্ন ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেয়ার পর একটি শিশু শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও তার জন্য সঠিক মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে। যদি কোন কারণে তারা মানসিক চিকিৎসা না পায় তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। হয়তো তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপনও করতে পারবে না। তারা এই আতংক সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াবে।

ডিএমসিএইচ-এর বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ খোন্দকার অগ্নিদগ্ধ রোগীদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও  সাইকোথেরাপি দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অগ্নিদগ্ধ শিশুদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। তারা কান্না ছাড়া আর কোনভাবেই তার কষ্ট প্রকাশ করতে পারে না। যদিও বা তারা দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে তারপরে তাদের মনে সারাক্ষণ একটা ভয় কাজ করে। এক্ষেত্রে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে একমাত্র তার পরিবার।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, রাজনৈতিক কর্মসূচিকালে পাঁচজন শিশুকে ব্যবহার করা হয়েছে। পেট্রোলবোমা-ককটেল ছোঁড়ার সময় পাঁচ জনসহ মোট ১১ শিশুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকারী সন্দেহে এক শিশু গণধোলাইয়ের শিকার হয়। পেট্রোলবোমা বানানোর সময় সরঞ্জামসহ পুলিশের হাতে আটক হয় তিনটি শিশু। 

অর্থাৎ শিশুরা বহুমাত্রিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তাদের প্রাণ যাচ্ছে। যারা বেঁচে থাকছে, তারা বয়ে বেড়াচ্ছে দুর্বিষহ জীবনের বোঝা। তাদেরকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে সহিংসতার কাজে। আবার মাসের পর মাস ধরে সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে বন্ধ থাকছে স্কুল, পিছিয়ে যাচ্ছে পরীক্ষা। অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে শিশুদের ভবিষ্যত।

ফেব্রুয়ারি মাসে সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাইকেল ম্যাকগ্রাথ স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থায়। স্কুলগুলো রোববার থেকে বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকছে। এতে শিশুরা ক্লাস করতে পারছে না। অনেক শিশুর পরীক্ষা পিছিয়েছে বারবার।’

তিনি বলেন, শিশুদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য আর সার্বিক কল্যাণের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাবের বাইরেও শিশুদের ওপর সহিংসতার মানসিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন আমরা। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু ভয়ের পরিবেশে বাস করে তারা সহিংসতার সংস্পর্শে অনেকভাবে বদলে যেতে পারে। নিরবচ্ছিন্ন ভীতি আর এই ভীতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার স্নায়বিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রচেষ্টা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। ক্ষতিগ্রস্ত করে তাদের শারীরিক, আবেগিক, আচরণগত, বুদ্ধিবৃত্তিক আর সামাজিক কার্যকারিতা।

নিরবচ্ছিন্ন সহিংস পরিবেশে বাস করা শিশুদের সহিংস হয়ে ওঠার আশঙ্কাও অনেক বেশি। বিশেষ করে ছোট শিশুরা ক্রমাগত সহিংসতার মধ্যে থেকে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে নিজেরাই সহিংস হয়ে উঠতে পারে। মূলধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস হারিয়ে ফেললে তারা এমনকি চরমপন্থার দিকেও ঝুঁকে পড়তে পারে।

অব্যাহত রাজনৈতিক সহিংসতা শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তার দায় এই রাষ্ট্র ও সমাজের। এই দায় সুশীল সমাজেরও। এই অনিবার্য অনিশ্চয়তা থেকে শিশুদের রক্ষা করতে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকেই। স্বাধীনতার মাস, মুক্তির মাস এই মার্চের চেতনা দিয়েই রুখতে হবে সব অপশক্তিকে। জাতীয় শিশু দিবসে সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

শেয়ার করুন: