
সুপ্রীতি ধর: আজকের বিষয় বন্ধুত্ব। যেহেতু কোন ডায়েরি নেই আমার সেই জীবনের, তাই বিষয় ধরে ধরে এগোনোই ভাল। তাতে হয়তো কিছুটা বাস্তবতা কিছুটা লেখকের ভাললাগার মিশেল থাকবে সেই লেখায়। আর বন্ধুত্ব এমন ব্যাপক একটা বিষয়, যা হয়তো এক পর্বে কেন, দশ পর্বেও তার সমাধানে আসা যাবে না। একটা বলতে গিয়ে অন্য আরেকটা ভুলে খেয়ে বসে থাকবো।
হঠাৎ হয়তো কোন ভিন দেশে পথ চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াবো, কেউ বলে উঠবে, বন্ধু, কী খবর বল? বন্ধুরা এমনই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে যে, আমাজনেও তাদের দেখা মিললেও মিলতে পারে। সোভিয়েত জীবন আমাদের বন্ধুত্বের পরিধিকে এতোটাই ব্যাপৃত-বিস্তৃত-প্রসারিত করে দিয়েছে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলেও আমার ওই সাড়ে নয় বছরের সোভিয়েত-রুশ জীবন সবচেয়ে দামী ভেলভেটে মোড়ানো একখণ্ড শাহনামা। মহাভারতও বলা চলে।
আমি আস্তিক নই, আবার নাস্তিকও নই। আমি আধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী, আমি লালনে পুজা করি মনে মনে, কবিগুরুকে পুজা করি, নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দসহ অসংখ্য কবির বাস আমার মননে। আর এতোসব কবির মাঝে আমি লালন করি কিছু বন্ধুকে, প্রাণের প্রিয় তারা আমার। কিছুতেই যায় না মোছা তাদের রেখে যাওয়া ছাপ আমার জীবনে। এদের অধিকাংশকেই পেয়েছিল আমি সোভিয়েতে এসে।
স্কুল-কলেজে, বা পরবর্তী কর্মজীবনে তেমন বন্ধু কেউ হয়ে উঠেনি আমার, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। নইলে বন্ধুর বন্ধু, তস্য বন্ধু কল্যাণী রমা আর তানিয়া মোর্শেদ যেভাবে আমার জীবনে আলো ফেলে চলেছে, এই কৃতজ্ঞতা আমি রাখবো কোথায়! ওদের জীবন আর আমার জীবন কবে কখন একাকার হয়ে গিয়েছে, তাও তো জানিনে।
সোভিয়েত বন্ধু সুস্মি এখন থাকে নিউইয়র্কে। একাই জীবন। দুটো মেয়েকে নিয়ে নিজেওেএকটু একটু করে বড় হয়েছে একইসাথে। ভেবে অবাক হই, যে মেয়েটাকে আমি খুবই আত্মভোলা একজন ভাবতাম সেই কিনা প্রতিদিন সকালে নিউইয়র্কের কুইন্স থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে কানেকটিকাটে যায় অফিস করতে, প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টার ড্রাইভ, ফিরেও আসে একইভাবে। ওর বাসায় তিনদিন থাকার সুবাদে দেখেছিলাম ওর এই চলমান গল্প। গল্প তো নয় হৃদয় খুঁড়ে দেয়া কাহিনী। আমি ওকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম, দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে বসে। চিরাচরিত মুচকি হেসে বলেছিল, গাড়িতে যখন উঠেই পড়েছো, এখন যেমনই চালাই, আমার সাথেই যেতে হবে। নামানামি নেই। প্রাণ হাতে নিয়ে বিড় বিড় করতে করতে তার বাড়িতে পৌঁছাই সেদিন। কিন্তু না, ও ঠিকই আছে। মাঝে মাঝে লাইন ক্রস করে যাচ্ছিল যদিও, বলছিল, প্রায়ই নাকি তাকে এই কাজের জন্য জরিমানা দিতে হয়।
তাতো হবেই। তুমি যা মেয়ে! তার বাসায় থাকার পরদিন সে আমার হাতে এক বোতল জল আর আরেকটা ছাতা ধরিয়ে দিয়ে, নিজেও একইরকম নিয়ে বের হয়ে যায় শহর দেখাবে বলে। সারাদিন হাঁটিয়ে, পায়ে ফোস্কা পড়িয়ে অবশেষে বাড়ি ফেরে। রাতভর সেই ভারী পা আমি তিনটা বালিশের ওপর দিয়ে তবেই রক্ষা পেয়েছিলাম। আর এই দেশে সুস্মির কী হাসি! হাসুক। এদিকে ওর মা, মানে আমার কাকি, আর আমার দাদার ভাবী, কত রান্না করে সাজিয়ে বসেছিলেন আমাদের জন্য! কী ছিল না সেই টেবিলে। এককোণে বসে সুস্মির বাবা আলী আনোয়ার স্যার/কাকা মাঝে মাঝে আমার সাথে কথা বলছিলেন। খুবই আস্তে আস্তে সেকথা।
সেটা ছিল ২০১০ সালের কথা। সেদিন মধ্যরাতে সু্স্মি তার ও আমার কাপড়চোপড় ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে খানিকটা বসেছিল গা ঘেঁষে। বললাম, এভাবেই থাকবে? বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললো, না পেলে তাই থাকবো, ফ্লার্ট করতে দেবো নাকি লোকজনকে? উল্টো আমাকে শুধোয়, তুমি পেয়েছো কাউকে? না’সূচক মাথা নাড়ি। কিন্তু ওর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকি, ও-ও ছাড়িয়ে নেয় না। যেন জন্মান্তরের বন্ধন এই দুই হাতে, কত না-বলা কথা বলা হয়ে যায় এই নীরব বসে থাকাতে। আগামী জুলাইয়ে সুস্মি দেশে আসবে, আমরা মানে শাওন, আমি ঠিক করেছি খুলনায় রুমার ওখানে যাবো, চারজন পা তুলে দিয়ে গল্প করবো সারাদিন-সারারাত, যে গল্পের কোন শেষ নেই। সেইদিনটার অপেক্ষায় আমরা। এই বন্ধুত্ব যে আমাদের প্রাণের চেয়ে বড় টান।

রুমারা থাকে খুলনায়। মস্কোর প্লেখানভ ইউনিভার্সিটি থেকে ইকনমিকসে মাস্টার্স-পিএইচডি করে এসেছে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থায় কাজের পাশাপাশি প্রথমে ব্যতিক্রমধর্মী অরতীর্থ স্কুলের পর এবার নিজেই সহজ পাঠ বলে একটা স্কুল দিয়েছে। বিশাল লাইন সেই স্কুলে ভর্তির জন্য। খুবই জনপ্রিয়। তো, সেই রুমা আমাদের চিরসবুজ, এতোটুকু দু:খকষ্ট যাকে ছুঁতে পারেনি এই জীবনে। কিছুদিন আগেই কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম, রুমা, চল না, শেষ বয়সটা আমরা একসাথে ডাল-ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিই! সাথে সাথেই বললো, কৃষ্ণনগরে আমার জায়গা আছে, দিয়ে দিচ্ছি তোদের, বাড়ি করে নে, চল একসাথে থাকি। এই যে ‘চল একসাথে থাকি’ কথাটার মধ্যে যে কত আন্তরিকতা, কত আবেগ, তা কেবল আমরাই জানি। তাইতো স্বপ্ন দেখি, সত্যিই সেই মাটিতে আমরা কজনা শেষবয়সে বাড়ি তুলে ডাল-ভাত, আলু ভর্তা ভাত খেয়েই দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবো। আমরা যদি একসাথে থাকি, সেখানে আর সবকিছুই গৌণ হয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আসল মাজেজাটাই এখানে। যে তারুণ্যে আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত, শুধুমাত্র গল্পে-কল্পনায় দেখা দেশে, সেই দেশটাতে একটু একটু করে থাকতে গিয়ে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যবঞ্চিত সেই জীবনে একটু একটু করে খাপ খাওয়াতে গিয়ে কাছের মানুষগুলোই কখন যে আপনার হয়ে গিয়েছিল, তাইতো জানা হয়নি। নতুন দেশ, ভিন ভাষা, ভিন সংস্কৃতি, সব মিলিয়ে নতুন জন্ম আমাদের। কেউ সেখানে হারিয়ে ফেলেছে নিজের অস্তিত্বকে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে মেতে উঠেছে উচ্ছৃঙ্খলতায়, কেউবা সেই দুর্লভ প্রাপ্তিকেই বুকে করে নিয়ে এসেছে। আমরা সেই নিয়ে আসাদের দলে।
শাওনের সাথে পরিচয় মস্কোতেই, সুস্মির বদৌলতে। সুস্মিকে চিনতাম আগে থেকেই আমার দাদার কারণে। সুস্মির কাকা আলী রীয়াজ আমার দাদার ক্লাসমেট-বন্ধু। সেইসূত্রে মস্কো যাওয়ার আগেই সুস্মির সাথে আমার দেখা। ভুলোমন হিসেবে শাওনের একটা দুর্নাম ছিল মস্কোতে। সে নাকি কোনদিন একে মেট্রোতে করে কোথাও পৌঁছাতে পারতো না, পথ ভুলে অন্য পথে সে যেতোই। তার প্রমাণও পেয়েছিলাম আমি মস্কো গিয়ে। তার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল আমাকে প্যাট্রিস লুমুম্বায় পৌঁছানোর। সে আমাকে নানাপথ ঘুরিয়ে, নানা ট্রেনে চড়িয়ে অবশেষে পৌঁছে দিয়েছিল। তা শুনে সবার কী হাসি! শাওনের একটা গল্প আছে। সে নাকি হাতব্যাগ ঝুলাতে ঝুলাতে যেতে পথে কোথাও ব্যাগটা হারিয়ে ফেলেছিল, সে টের পায়নি। পরদিন দ্বিজেন কাকুর (দ্বিজেন শর্মা) ফোন পেয়ে তার সম্বিত ফেরে। কোন এক লোক সেই ব্যাগ খুঁজে পেয়ে একটা ঠিকানাই পেয়েছিল, আর সেখানেই সে পৌঁছে দিয়েছিল। সোভিয়েত সিস্টেম তখনও কার্যকর ছিল কিনা!
কিন্তু তারই বছর দেড়েক পরে প্যাট্রিস লুমুম্বার ডাইনিংয়ে খেতে গিয়ে লেনিনগ্রাদ থেকে যাওয়া আমি ব্যাগটা ভুলে ফেলে আসি। পরক্ষণেই মনে পড়াতে ফিরে গিয়ে আর পাইনি। সেদিন আমার খুব কান্না পেয়েছিল। বৃত্তির ৭৫ রুবল, একজোড়া সোনার কানের রিং ছিল ব্যাগটাতে। হাতে আর টাকা নেই। সেদিন শাওন আমাকে ২৫ রুবল ধার দিয়েছিল একটা ব্যাগ সমেত। সেই টাকা আমার আর কখনই দেয়া হয়নি। ২৫ রুবলও তখন অনেক ছিল। সেই টাকা নিয়ে আমি সম্মেলনে পর্যন্ত গিয়েছিলাম। শাওন আমাকে অবশ্য কোনকিছুই কিনতে দেয়নি যে কদিন ছিলাম। এই হলো শাওন। এখন পেট্রোবাংলার সিনিয়র কর্মকর্তা, আমাদের প্রাণের বন্ধু। পিছনে বসে যেসব বন্ধু ছুরি মারে, এরা তা নয়।
আছে জাহীদ রেজা নূর। ওর সাথে আমার দ্বিমতের শেষ নেই। সবসময় একটা শাসানোর ভঙ্গিতে থাকে। কিন্তু রাশিয়ার ক্রাসনাদার থেকে যখন সে ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ লেখা পাডে চিঠি লিখতো নিয়মিত, সেই চিঠি যে কত হাজার মাইল পেরিয়ে নেভা তীরের মেয়েটিকে আন্দোলিত করতো, বন্ধুটা আমার সেখবর জানেনি কখনও। প্রচণ্ড উৎসাহ দেয়া সেই চিঠি। চিঠি তো নয়, সব গল্প আর গল্প। পরবর্তী জীবনে একই কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সুবাদে বন্ধুত্ব আরও প্রগাঢ় হয়, অথচ দেশের বন্ধুদের মধ্যে কতজন যোগ-বিয়োগ হয়েছে এ জীবনে তার ইয়ত্তা নেই। জাহীদ রয়ে গেছে, ঠাঁয়, সেই ৮৬ সালের টিএসসির সামনে রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া জাহীদ হয়েই।

তপুর কথা না বললে ও কষ্ট পাবে। আমাদের নিয়ামুল হক তপু। মস্কোতে থাকতো, প্রায়ই যেত সে আমার শহর লেনিনগ্রাদে। চিত্রকলাই তাকে ডেকে নিয়ে যেত। আমি হতাম তার সেই চিত্রকলা দেখার অনভিজ্ঞ সঙ্গী। হেরমিটেজে ঘুরে ঘুরে সে একেকটা ছবি দেখাতো, আর গল্প করতো মাতিস, রেমব্রান্ট, ভ্যান গগ, গোঁগা, পিকাসোকে নিয়ে। ওর সাথে ঘুরে বেড়াতাম বনে-বাদাড়ে। গাছ চেনাতো। প্রতিদিনই নতুন নতুন গাছের নাম বলতো, আমাকে দিয়ে তা বার বার বলিয়েও নিতো। কিন্তু পরদিন জিজ্ঞাসা করলেই গুলিয়ে ফেলতাম অন্য গাছের নামের সাথে। কী মুশকিল!
বলতাম, আসো, তোমার চোখ দিয়ে আমি শিল্পকলা দেখি। ওর সাথে ঘুরে ঘুরেই কিনা অসম্ভব ভালবাসা জাগলো আমার শিল্পকলার প্রতি। ঠুস করে ভর্তি হয়ে গেলাম হেরমিটেজের সান্ধ্যকালীন কোর্সে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পকলার বিবর্তন পড়লাম। এরপর থেকে হেরমিটেজের ছবিগুলো আমার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠলো তাদের ইতিহাস নিয়ে। কী সুন্দর সেই অনুভূতি। ধন্যবাদ তপু তোমাকে।
আসলে বন্ধু নিয়ে মোটে তো শুরু, এ লেখার অনেকগুলো পর্ব লাগবে। ততদিন সবার ধৈর্য থাকলেই হলো। আমার বিদেশি বন্ধুদের কথা তো এখনও বলিইনি। ওরা যে আমার কী ছিল, আমি কেন, স্বয়ং ঈশ্বরও জানে না। ওরা না থাকলে আমার জীবন অসম্পূর্ণ হতো। ওরা আছে, ওরা থাকবেও। হয়তো কল্পনায়, জীবনাচরণে। (চলবে)