ইশরাত জাহান ঊর্মি: : কত চিন্তা-অপচিন্তার ছটফটানিতে থাকি। থাকি ঘরে-বাইরের চেনা-অচেনা কত টানাপোড়েনে। যেন বা কাগজের নৌকায় পাড়ি দিচ্ছি আগুনের নদী। শক্তি চাই।
ভেবে দেখেছি, যৎসামান্য যে শক্তিটুকু আছে আমার, তার সিংহভাগ এসেছে পঠন-পাঠন থেকে। বই নামের রহস্যময় সঙ্গীটি দেখেছি বাঁকে বাঁকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়েছে পথ। সম্পর্কের জটাজাল, টমেটোর দাম, জনপদের ভবিষ্যত ইত্যকার ঘোর কুয়াশা সরিয়ে দিয়েছে কোথাও কোন বইয়ে পড়া কবিতার এক পঙক্তি। নিরেট, বিখ্যাত যে বাস্তব ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে চোখের সামনে, তার মানে বুঝিয়ে দিয়েছে বই।
কিন্তু আজকাল ধন্ধে পড়ি কখনও কখনও। ভাবি, আমার সেই মায়াবী সঙ্গীটির কি আর আগের মতো প্রতিভা আছে? চারপাশের যে মই মই খেলা, লাভ-ক্ষতির যে আগ্রাসী হিসাব, ডটকম, সিমকার্ডের যে মহোৎসব, তাতে মনে হয়, “বই” বুঝি এখন তার সেই লাবণ্য হারিয়েছে। উদ্বিগ্ন হই। যদিও বছরে অন্তত: একটি মাস মুক্ত থাকি সেই উদ্বিগ্নতা থেকে। দেখি, ছেলেমানুষী উদ্দীপনায় ছুটে যাচ্ছে বইয়ের মেলায়। যেন মন্ত্রপূত ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে বইয়ের বাগানে।
সারাবছর বই পথহারানো মোরগের মতো একা বৃষ্টিতে ভিজলেও অন্তত: একটি মাস সে বসে সিংহাসনে।
ভেবে দেখলাম, তখনই আসলে আমি সবচেয়ে ভালো থাকি যখন আমি খারাপ থাকি, সংকটে থাকি। সেদিন ইনবক্সে একজন লিখেছেন, খারাপ থাকাই আসলে ভালো। কারণ খারাপ থাকলে বিস্বাদ লাগে আর বিস্বাদ লাগলে লেখা আসে। সত্য বলে মানি। আমার এখন লেখা আসছে না। কারণ আমার…
পূর্ণিমা রাতে ঐ ছোটাছুটি করে কারা,
আবেগে কাঁপিছে আঁখি
বসন্ত এসে গেছে…
ক্যালেন্ডারের পাতার থোড়াই কেয়ার করি। আমার বসন্ত এসে গেছে। কারণ বইমেলা এসে গেছে। আমি তাই খুব ভালো আছি। আর ভালো আছি বলেই লেখা আসছে না কোন। সঙ্গত কারণেই তাই প্রিয় লেখকের লেখা থেকে তুলে দেওয়া।
আমি খুব আনন্দে আছি। এবার মেলায় বই আসছে আমার। কারণ কি সেটাই? আপনারা জানেন, বন্ধুগণ, সেটা কোন বকারণ নয়। বই যখন আসেনি বা আসেনা তখনও এই মাসটা আমি এমনই খুশি থাকি।
বইমেলা কি শুধু বই বেচার জায়গা? অথবা টিভি ক্যামেরার সামনে উদ্ধত কিংবা নতমুখী বয়ান দেওয়া? বইমেলা কি সেইসব তরুণদের লেখক বলে নাম কামাবার প্রাণান্তকর চেষ্টার জায়গা? যাদেরকে কখনই বলা হয় না, এভাবে হয় না হে। তোমাদের এইসব নাম কামাবার অস্ত্রপাতি খুব শিগগীরই চলে যাবে মহাকালের ভাঁড়ারঘরে। জানবেও না তুমি।
অথবা অটোগ্রাফ দেওয়া আধা প্রতিষ্ঠিত লেখক। সারাক্ষণ দুরুদুরু বুক। এই বুঝি নতুনের কেতন উঠলো, বাজার বুঝি পড়লো। তাদেরকেও বলা হয় না, দলবাজি আর ছাতার নীচে না থেকে কি হয় একটু সৎ হলে, একটুখানি সরস্বতী সাধনা করলে?
অথবা লিটিল ম্যাগ চত্ত্বর। ছোট কাগজের ঢেউ-এ, ছোট ছোট পদ্য ভেসে আসে…
ওদের বলার ভঙ্গি, ওদের ঠোঁটের কোণের হাসি সবই কেমন বাম-বাম। যারা সব কথা লম্বা করে বলে, যাদের ভাষা ঠিক বুঝা যায় না।
অথবা সেইসব সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠিত লেখক। যাদের কাছে এই কোনও শ্রেণীর লেখকই মনুষ্য পদবাচ্য নন। অচ্ছুৎ। যেন আর কারুর লিখতে পারার কথাই না। যেন আর সবাই আকাট মূর্খ্, শুধু তারাই জ্ঞানের আধার! আমার হাসি পায়। পৃথিবীর সব ক্ষুরধার তলোয়ারই একদিন ভাঙে মরচে লেগে।
আর আমার লাভ হলো এই সবকিছুর যোগফল। বই বেচা না বেচা প্রকাশকের হেডেক। আমি কতজনের চিন্তার সাথে যুক্ত হতে পারছি, কতজনের সাথে বিনিময় করতে পারছি ভাবনা, বইমেলা ছাড়া এমন সৌগন্ধের সন্ধ্যা আর কে উপহার দিতে পারে? আমাকে?