
সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: ‘নারীরা মরে গেলেও কী লাশ না হয়ে নারীই থাকে? মুসলিম নারীর মৃত্যুতে তার জানাযায় অংশ নেয়ার জন্য মাইকিং করা হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে মাইকিং করা হলেও মৃত ব্যক্তির নাম না বলে তার স্বামী বা ছেলের নামে তার পরিচয় দেয়া হয়। এই নারী জীবদ্দশায় যতই স্বমহিমায় মহিমান্বিত থাকুন না কেন তার অখ্যাত স্বামী বা সন্তানই তখনও লাশ নারীর পরিচয় হয়ে ওঠেন! কেন?’
এমন একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার পর ওয়ালে লাইক-কমেন্ট তেমন না পড়লেও ইনবক্সে অনেকেই ঝড় তোলে কথার। যারা নিজেকে অনেক প্রগতিশীল, চিন্তাশীল ও সংবেদনশীল দাবি করেন, তেমন মানুষগুলোও ওয়ালে লেখার সাহস দেখাতে পারে না। তাদের একটা বড় অংশ ‘নারী পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার’ এর বেশী কোন যুক্তি দিতে রাজি নন। আবার কেউ কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্যাখ্যা দেন এই বলে যে, নারীর মৃত্যু সংবাদ মাইকে ঘোষণা হলে পুরুষেরা একজন নারীর নাম শুনে তাকে কোনদিন না দেখলেও কল্পনায় একটি নারীর শরীর দেখবে। এই শরীর তাদের মনে কামভাব জাগাতে পারে। তাতে মৃত নারীর পাপ হবে! তাই নারীর জানাজার খবর মাইকে না বলার চেষ্টা করা হয়। আবার একজন বললেন, মৃত নারীর মুখখানিও দেখা দেয়া হয় না পুরুষকে। শুধুমাত্র সন্তান ও স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষ মুখটা দেখলে মৃত নারীর পাপ হয়!
লাশের নাম পুরুষ শুনলে বা মুখ পুরুষ দেখলে পাপ কেন লাশের হবে? এমন জবাবে আবারো একই জবাব –‘পুরুষের কামভাব জাগতে পারে।’ কামভাব যদি পুরুষের জাগ্রত হয় তো পাপ কেন নারীর হয়? তাও আবার মৃত নারীর!
একজন পুরুষ মগ কর্মী শতাধিক নারীর লাশের সাথে সেক্স করেছে এমন খবর পত্রিকায় এসেছে। আবার কবর থেকে তুলে লাশের সাথে সেক্স করেছে পুরুষই। এই খবরও পত্রিকায় দেখেছি। যখন প্রশ্ন আসে সেই সব লাশ কি এই পুরুষদের কামভাব জাগিয়েছিল? নাকি জাগাতে উদ্বুদ্ধ করেছে? এক্ষেত্রেও নাকি সেই লাশ নারীর পাপ হয়েছে, যদিও পুরুষের কিছু পাপ হয়েছে বলে ব্যাখা দিয়েছে জবাব দাতা।
কেউ একজন স্ট্যাটাস পড়ে আমাকে হতাশা থেকে বেরিযে আসার পরামর্শ দিয়েছে। যাতে আমরা নারীরা এসব পুরনো কথা না বলে নতুন কথা বলি সে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। পরিবর্তনে নারীকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ কেউ আমাকে জ্ঞানপাপী বলেছেন, অশ্লীল ভাষায় গালিও দিয়েছেন। সবই ইনবক্সে।
আমি কি হতাশা থেকে স্ট্যাটাস দিয়েছি? মোটেও না। ধর্মের নামে নারীর প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বরং পুরুষের জন্য আমার করুণা হয়। জীবিত নারীর শরীর দেখে বা কল্পনায় দেখে পুরুষের কামভাব তো জাগেই, আবার লাশ নারী শরীর দেখে বা কল্পনায়ও তারা সজাগ হয়। সমাজে পুরুষরা নিজের পাপ ঢাকতে নারীর পাপ বলে চালিয়ে দেয়। নারীর শরীর দেখে পুরুষের কামভাব জাগ্রত হয় বলে নারীকে পর্দার আড়ালে রাখতে চায় পুরুষ। নারীকে উচ্চস্বরে কথা না বলার শিক্ষা দেয়া হয। এমনকি কোরান পাঠ করার সময়ও যেন কোন নারীর কণ্ঠ অন্য কোন পুরুষ না শুনতে পায় সেই ভাবে পড়তে বলা হয়। কোরান পাঠের কণ্ঠ শুনেও পুরুষ প্রভাবিত হতে পারে! কি আশ্চর্য! অথচ প্রতিটি ঘটনার জন্য নারীকেই পাপী করে রাখে তারা।
দু’একজন আবার মার্গারেট থ্যাচার ও ইন্দিরা গান্ধীর কথা বলেছেন যারা জীবিত-মৃত উভয় অবস্থায় সমান আলোচনায় থেকেছেন। এই নারীরা কি নারীই থেকেছেন? নাকি নারী পুরুষের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন? তাছাড়া তারা মুসলিম পরিবারভুক্ত ছিলেন না।
কেউ কেউ আবার আমার এমন উদ্ধত(!) প্রশ্ন করার জন্য ওপারের শাস্তিময় বসবাসের রায় দিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আমার এক পরিচিত সম্ভ্রান্ত নারী মারা যান। তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন ৩৭ বছর। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় থেকে কাজ করে গেছেন দীর্ঘ সময়। তার মৃত্যু সংবাদ আমি ফোনে পাই। পরদিন দাফনের আগে সে বাড়িতে গিয়ে দেখি আত্মীয়-স্বজন ছাড়া তেমন কোন মানুষ নাই। কারণ জানতে চাওয়ায় শুনলাম মাইকিং করা হয়নি। কাছের আত্মীয় ছাড়া তেমন কেউ জানেও না। তাছাড়া মসজিদের সামনে জানাজার সময়ও কোন মাইক ব্যাবহার করা হলো না। কারণ হিসেবে বলা হলো নারীর লাশ যত দ্রুত সম্ভব পরিবার-পরিজনরা মিলে কবর দিলেই কবরের আজাব কম হয়।
সেই বাড়ির একজন পুরুষ মারা গেছেন বছর কয়েক আগে। তিনি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী ছিলেন। তার মেয়ে-জামাই দেশের বাইরে ছিলেন। আরো অনেক আত্মীয়-স্বজন বিভিন্ন জায়গায় থাকায় তার লাশ দুইদিন হিমঘরে রাখা হয়। প্রায় তিন দিন ধরে মাইকিং করে জানাজায় শরিক হওয়ার অনুরোধ জানানো হয় শুভাকাঙ্খীদের। সেদিন রেকর্ড সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাজা হয়েছিল। তখন জানাজা পরিচালনাকারী বলেছিলেন, জানাজায় বেশী মানুষের উপস্থিতি ও প্রার্থনা সেই ব্যাক্তির পাপ মুছে দেয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতেই পারে। তবে সেই ভিন্নতাটাই ব্যতিক্রম। তাই আমার প্রশ্নটা রেখেই দিলাম। জবাব যদি কারো জানা থাকে—-।
সাংবাদিক ও লেখক