এক বন্ধু লিখেছে, “নারীরা মরে গেলেও কী লাশ না হয়ে নারীই থাকেন? নারীর মৃত্যুতে তার জানাযায় অংশ নেয়ার জন্য মাইকিং করা হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে মাইকিং করা হলেও মৃত ওই নারীর নাম না বলে তার স্বামী বা ছেলের নামে তার পরিচয় দেয়া হয়। এই নারী জীবদ্দশায় যতই স্ব-মহিমায় মহিমান্বিত থাকুন না কেন, তার অখ্যাত স্বামী বা সন্তানই তখন লাশ নারীর পরিচয় হয়ে ওঠেন! কেন”?
ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি পড়ার পর মনে হলো, সত্যিই তো! এমনভাবে তো ভাবা হয়নি আগে! মনে করতে চেষ্টা করি, জীবনে যতো মাইকিং শুনেছি মৃত্যুর খবরসহ, সেখানে কতজন নারী ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, থাকলেও তাদের পরিচয় কি দেয়া হয়েছে!
মনে পড়ে গেল, আমার নিজের মায়ের মৃত্যুতেও মাইকিং হয়েছিল ছোট্ট মফস্বল শহরটিতে। যে মা তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন সন্তানদের ভবিষ্যত গড়ার জন্যে, নিজের জন্য ভাবেননি এতোটুকু, যে মায়ের একটা পারিবারিক জীবনেরও বাইরেও ছিল রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য ইতিহাস, সেই মায়ের মৃত্যুতে ‘অমুকের স্ত্রী এবং অমুকের মা’ হিসেবেই মাইকে বলা হয়েছিল।
এটার আরও একটা কারণ, আমাদের মায়ের নাম খুব কম মানুষই জানতো। একই শহরের মেয়ে হলেও, পরবর্তীতে মায়ের পরিচয় ছিল ‘অমুক বাবুর স্ত্রী’, তারও পরে ‘অমুক-তমুকের’ মা। তবে ছোটবেলায় স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের কাছে মায়ের নাম শুনতাম। তারা জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি কি কমলার মেয়ে? নাকি ছানার মেয়ে? তোমার মা কি ঘোড়ায় চড়ে ক্লাসে আসতো? যখন বলি, আমার মাসী আসতো ঘোড়ায় চড়ে, আমার মা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতো, সেই মানুষগুলোর চোখ তখন চকচক করতো। আমি খুব এনজয় করতাম বিষয়টা। তাদের কাছে তখন আমারও কদর বাড়তো।
কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে চলে আসার পর সেই মায়ের পরিচয়টাই বদলে যায়, বদলে যায় আরও অনেক কিছু। বোহেমিয়ান বাবার সংসার করতে গিয়ে বনেদী মায়ের দিনরাত কঠোর সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া মা আবারও বিপরীতেই চলেন। চাকরিতে ঢোকেন। তিন-তিনটি ছেলেমেয়ে তার তখন। একদিকে সংসার, অন্যদিকে ছেলেমেয়েকে মানুষ করার অদম্য ইচ্ছা। দোটানায় ভেসে যেতে যেতে আরেকজন আসে ঘরে। হয় চারটি সন্তান। দুধের শিশুকে কখনও সাথে নিয়ে, কখনও বাড়িতে রেখে চলতে থাকে সেই লড়াকু মায়ের জীবন-সংসার।
একাত্তরে স্বামীকে হারায় মা। শুরু হয় একাকি জীবন, সঙ্গে চারটি প্রাণ। তাদের গড়ে তোলাই তখন একমাত্র লক্ষ্য। এতোকিছু করেও মায়ের আলাদা সত্ত্বার স্বীকৃতি পায় না। সন্তানের কৃতিত্ব মায়ের কৃতিত্ব হয়ে উঠে না। বলা হয় না, কমলার ছেলে বা কমলার মেয়ে ভাল করেছে।
নিজেদের যতই অত্যাধুনিক ভাবি না কেন, আসলে কেউ আমরা আধুনিক নই মননে-চিন্তায়। আমাদের বাড়ির বউ খোঁজার সময় ফর্সা গায়ের রং দেখা হয়, পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না কেউ, বউ হতে হবে সুন্দর, যেন কেউ দেখলেই বলে, ‘তোমাদের বউগুলো খাসা হয়েছে’। অথচ একই বাড়ির মেয়েরা একেবারেই বিপরীত, যেমন দর্শনে-তেমনি গুণবিচারেও। পড়ালেখায় তারা উচ্চশিক্ষিত, কর্মঠ হয়েও মর্যাদার ক্ষেত্রে তথৈবচ। আশ্চর্য বৈপরীত্য। বহু বছর আগে ভাইয়ের জন্য বউ খোঁজা হচ্ছে হারিকেন দিয়ে। সারাদিন ফর্সা রংয়ের কথা শুনতে শুনতে দাদীমাকে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা, তোমরা যে এতো রং-ফং করছো, আমার বিয়ে কিভাবে দেবে?’ হকচকিয়ে যাওয়া দাদীমা অনেকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই তো অনেক সুন্দর, তোর চোখ সুন্দর, চুল সুন্দর, হাসি সুন্দর’। হেসে বলি, ‘ তাইলেই বা কী, রং তো শ্যামলা’।
নতুন প্রজন্মের ছেলের বিয়েতে শাশুড়ি হয়ে আবদার করেছিলাম, ‘বউ-ভাতের সময় থালাভর্তি খাবার নিয়ে স্বামী যেমন বলবে, আজ থেকে তোমার যাবতীয় ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি নিলাম, তেমনি বউও যেন বলে, আমিও তোমার যাবতীয় দায়িত্ব নিলাম’। আমরা এই বাড়ির মেয়েরাই তো সেই যুগ যুগ ধরে কত দায়িত্ব পালন করে আসছি, তাহলে অন্য বাড়ির মেয়েরা তা বলবে না কেন? কিন্তু আমার কথাটা কেউ রাখেনি। বলতে দেয়নি কেউ। যেন বউয়েরা এসব দায়িত্ব নেয়ার কেউ না, দায়িত্ব যা নেবার, তার জন্য মেয়েদেরই তৈরি করা হয়েছে।
সেই মায়ের মেয়েও যখন মায়ের মতোনই লড়াকু হয়, তখনও মানুষ কার্পণ্য করে সামান্যতম উৎসাহ দিতে। প্রতিটা মানুষের জীবনই উঁচু-নিচু, কমবেশি খানাখন্দে ভরা। তবে কারোরটা বেশি, কারোরটা কম। খুব কম মানুষই আছে, যাদের জীবন সহজ-সরলরেখায় চলে যায়। যৌথ জীবনেও কেউ সুখী, কেউ সুখী নয়। আর একা হলে তো কথাই নেই। একা মানুষের ‘প্যারা’ অনেক। তাদের কষ্টের ভাগটাই বেশি হয়। সেখানে যদি অর্থের টানাটানি থাকে, তবে তো কথাই নেই।
আসলে মা বলেন, আর মেয়েই বলেন, নারী নারীই। তাদের স্বীকৃতি কদাচিৎ মেলে ঠিকই, কিন্তু সেই পরিমাণ পথ তাদের হাঁটতে হয়। এখন কেউ যদি বেশি পথ হাঁটে, অথচ স্মুথলি হাঁটে, আর কেউ সামান্যতম পথ হাঁটতেই যদি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়, সেই দায়ও কিন্তু এই সমাজেরই।
পরিচিত অনেকেই আছেন, যারা একার জীবনটাকেও উপভোগ করেন নানাভাবে। সেখানেও অনুষঙ্গ ওই একটাই, ‘অর্থ’। আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ওই ব্যক্তির চারপাশের পরিবেশ। সেটাকেও সহায় হতে হয়। কেউ যদি জানে জীবনটাকে নিয়ে সে কি করবে, তাহলে উপরের ওই দুটো জিনিস থাকলে খুব চালিয়ে দেয়া সম্ভব। পারিবারিক ভালবাসা থাকলে কোনো একক ব্যক্তির ভালবাসা না থাকলেও জীবন চলে যায়।
কিন্তু একা মানুষের দু:খ-কষ্টগুলোকে এড়িয়ে চলা মানুষেরও অভাব নেই। পারতপক্ষে কেউ ওই ব্যক্তির পথ মাড়ায় না। আর যদি কোন দায়িত্ব পালনের সম্পর্ক থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। তাদের নামকরণ করা হয় দু:খবিলাসী। কিন্তু কেন সে দু:খকে বিলাস করছে, আদৌ করছে কিনা তা জানার এবং নিরসনের উদ্যোগ কেউ নেয় না। সবাই উপদেশ দিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম লেখাটা, নারীর পরিচয় দিয়ে। মৃত্যুর পরের পরিচয়। বিষয়টা হচ্ছে, জীবদ্দশাতেই যে নারীর পরিচয় নিয়ে সমাজ কুণ্ঠাবোধ করে, মৃত্যুর পর তাকে সমাজ মূহূর্তেই মাথায় তুলে নাচবে, এটা আশা করাও বোধ হয় অন্যায়।
কিছুদিন আগে পরিবেশবিদ রিজওয়ানা হাসানের স্বামীকে অপহরণ করা হয়েছিল। সবজায়গায় তখন নিউজের শিরোনাম হয়েছিল রিজওয়ানার স্বামী হিসেবেই। কারণ একের পরিচয় অন্য ছাপিয়ে গিয়েছিল বলেই। কিন্তু এ নিয়েও কম কটাক্ষ হয়নি। নিজের কানে শুনেছি, ‘আহারে বেচারা, বউয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে হচ্ছে’। যারা বলেছে, তাদের পৌরুষে লেগেছে এই ঘটনা। স্পষ্টই বোঝা যায়, ঘরে তারা কেমন স্বামী, কেমন বাবা। ভাই বা সহকর্মীই বা কেমন!
চারপাশে তাকিয়ে দেখি, সব একেকজন পুরুষবাদী পুরুষ, ঠিক ‘সমমনা মানুষ’ দেখি না, যাদের হাতে নিশ্চিন্তে হাত রাখা যায়, কাঁধের দূরত্ব তো আরও অনেক।
সমাজ-সংসারে মানিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কি কেবল একা নারীরই? পুরুষের না? (চলবে)
শুধু ফরিয়াদে কোনো কাজ হবে না।জিবনের সকল পরিচয় ম্রিত্যুর পর মাটিতে বিলিন হয়ে যায়।তাই সেটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।কাল বলেছিলাম, নারির জিবন ঘনিশঠ শিকখার কথা।নারি যেনো নিজেকে মানুশ ভাবতে শেখে, সেই শিকখার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।এখনও আমরা ছোটোছোটো মেয়েদের বোম্বাই ফিল্মের ফ্যাশনের নানা ঢঙের জামা পরাইছোটো থেকেই মেয়েদের ‘মেয়ে’ হিশেবে গড়ে তুলি।বিয়ে, শশুর বাড়ি, নিজের শরির সম্বন্ধে সচেতন হতে হতেই তারা বড়ো হয়।আমরা মেয়েদেরকে প্রক্রিতির বিভাজন বুঝতে দিই না।আর বাইরে নারি মুক্তি নারি মুক্তি করি। আসলে নারি যদি মেধায় মননে শিকখায় যোগ্যতায় চেতনায় চৌকশ মানুশ হয়, তখন তার প্রতি ক্রিপা করা সহজ হয় না।কালই তো বলেছিলাম, অনাকাঙ্খিত ধর্শনকে দুর্ঘটনা বলতে হবে।যারা আপোসে প্রাক বিয়ে সম্পর্ক করে,তাদের তো সমস্যা হয় না।জানি ধর্মের বিধানের কথা এখানে আসবে।সেটা জেনেও তো মানুশ নানা বিপথে যায়। সেজন্য কি তার সারা জিবন নশট হয়ে যায়? তাকে দুর্ঘটনারঘা বা বাজে কাজের অনুতাপের সময় দিতে হবে।জিবন এতো সহজ শব্দ নয়।সোজা কথা মেয়েদেরকেই নিজের সম্মান আদায় করে নিতে হবে।কতো ট্যাবুই তো আমরা ভেঙেছি।আরো অনেক ট্যাবু ভাঙতে হবে।শরিরের পবিত্রতার কথা যদি ওঠে,তাহলে নারি পুরশ দুজনের শরিরি পরিত্রতার কথাই বলতে হবে।একজনের কর্মে কারো শরির নশট হয় না।তাই নারির একা কেনো লজ্জা হবে? অন্য পকখেরো লজ্জা হতে হবে।