আমরা যারা একলা থাকি-২৯

imp 1উইমেন চ্যাপ্টার: অদ্বিতীয়ার গল্প- ৪ । বেশ কয়েক বছর কেটেছে এর মধ্যে। জীবনকে একধরনের স্থিতির মধ্যে নিয়ে এসেছে অদ্বিতীয়া। অফিসের কাজের বাইরেও আরও অনেক ধরনের কাজের সাথে জড়িয়েছে নিজেকে। আগে যেমন জীবনটা তার কাছে ছিল দিনগত পাপক্ষয়, এখন বরং জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছে সে। মানুষকে কতভাবে সহায়তা করার আছে। তার একটু খানি সহায়তায় একটা মানুষের জীবনের দিক বদলে যেতে পারে এটা জেনে সে নিজেকে আর অর্থহীন অপাংক্তেয় মনে করছে না।

ছেলে-মেয়েকে নিয়েও বেশী চিন্তা করতে হচ্ছে না। ওরা অনেকখানি স্বনির্ভর। হয়তো পরিস্থিতিই ওদেরকে এভাবে হতে শিখিয়েছে। নিজেদের দায়িত্ব ওরা নিজেরাই সামলায়, মাকেও সাহায্য করে। অদ্বিতীয়ার মেয়েটি একটু শৌখিন। তারপরেও শখের কোন জিনিসের জন্য বায়না ধরে না সে। খুব বেশী ইচ্ছে করলে জানতে চায় মার হাতে কি কিছু বেশী টাকা আছে কিনা! মাকে কোনভাবেই কষ্ট দিতে রাজী নয়।

সেই জীবনের শেষের দিকের কয়েকটি বছরে অদ্বিতীয়া শুধু মনে নয়, চেহারায়ও ভেঙ্গে পড়েছিল। অদ্বিতীয়ার সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল। কিন্তু জীবনের অসম যুদ্ধে লিপ্ত অদ্বিতীয়া বহিরাঙ্গেও প্রায় বাজপরা গাছের মতন হয়ে গিয়েছিল। জীবনের স্থিতির সাথে সাথে অদ্বিতীয়া আবারো পুরোপুরি না হলেও, আগের লাবণ্য ফিরে পাচ্ছিলো। জীবন আসলেই থেমে থাকে না।

মানুষের জীবনের চাইতে বৈচিত্র্যময় আর কিছু নয়। সতেরো বছর বয়স থেকে এই পর্যন্ত এত চড়াই উতরাই পার হয়ে এসে জীবনের এই পর্যায়ে অদ্বিতীয়ার মনে ভাল লাগার রং ধরতে শুরু করেছে আবার! ভালো লাগতে শুরু করেছে একজনকে। অপরপক্ষেরও কিছুটা সাড়া ছিল। জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে অদ্বিতীয়া পরামর্শ করতো মানুষটির সাথে। অদ্বিতীয়ার মনের মধ্যে মানুষটি জায়গা করে নিচ্ছিল ক্রমশ। তবে ঠিক প্রেম কি বলা যাবে সম্পর্কটিকে! বন্ধুত্তের চাইতে বেশী তো ছিলই। পরপস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছিলো। হয়তো অদ্বিতীয়ার একাকীত্ববোধের কারণেই সে একটু বেশী ঝুঁকে পড়েছিল। মানুষটি মোটামুটিভাবে পরিচিত সমাজে। লোকে তাঁকে একজন সৎ আর ভাল মানুষ হিসেবেই চেনে, সম্মান করে। নিজের সংসারে তার এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছিল, তাই হয়তো এই কাছে আসা। তবে এই বন্ধুত্তকে জনসমক্ষে আনার মধ্যেও এক ধরনের দ্বিধা ছিল। চলছিল এভাবেই।

অদ্বিতীয়া হঠাৎ অসুস্থ হল বেশ বড় রকমের। ডাক্তার দেখানো, বুদ্ধিপরামর্শ করা সব কিছু মানুষটির সাথেই হতো। অদ্বিতীয়া দেশের বাইরে গেল চিকিৎসা নিতে। মানুষটি সাথে না গেলেও দিনে কত বার যে ফোন করে খবর নিতেন। বেশ কিছুদিন লাগলো অদ্বিতীয়ার সুস্থ হতে, যদিও রোগমুক্তি পুরোপুরি ঘটলো না তার। চিকিৎসাধীন থাকতে হবে সারাটা জীবন। এই কঠিন সত্যকেও সে মেনে নিতে পারলো ছেলে-মেয়ের ভালবাসায় আর মানুষটির আন্তরিক সহমর্মিতায়।

কিন্তু হঠাৎই একদিন অদ্বিতীয়াকে মানুষটি জানালেন যেহেতু এই সম্পর্ক তাদেরকে কোনও বিন্দুতে পৌঁছুতে দিবে না, তাই এটি দীর্ঘায়িত না করাই দুজনের জন্য মঙ্গল। এই সত্য অদ্বিতীয়া যে জানতো না তাতো নয় । তবুও আবার মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো সে। সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির স্নেহ, মমতা ভালবাসায় সে এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠলো। অদ্বিতীয়ার বন্ধুটি নিজের স্বামী সংসার ফেলে দিনের পর দিন তাকে সামলালো। অদ্বিতীয়ার হয়ে বন্ধুটি জানতে চেয়েছিল মানুষটির কাছে, যে এতদিন পরে এই কথা না বলে প্রথম থেকে পরিষ্কার করে নিলেই তো আর অদ্বিতীয়ার এই ধাক্কা খেতে হয় না। মানুষটি উত্তরে জানিয়েছিল, তার পক্ষ থেকে যতটা নয়, অদ্বিতীয়াই বরং নিজের থেকে এইসব কল্পনা করে নিয়েছে, বাস্তবতা সবসময়ই ভিন্ন ছিল। বাস্তবতা! বাস্তবতার কঠিন চাতালে অদ্বিতীয়াকেই বার বার আছড়ে পরে হৃদয়ের পাঁজর ভাংতে হবে!

ধাক্কাটি সামলে ওঠার চেষ্টায় অদ্বিতীয়া নিজেকে পালটে ফেলার চেষ্টা করে। এই জীবনে আর কোনও মানুষের হাত সে ধরবে না। একাই পাড়ি দিবে বাকী জীবন। অদ্বিতীয়া আরও শক্ত জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখতে শিখতে এক ধরনের অবিচল মনোভাব তৈরি করে ফেলেছে নিজের মধ্যে। এরই মধ্যে কেটে গেল আরও কিছু সময়।

মানুষের জীবনের চাইতে বিচিত্র কোনও গল্প কি উপন্যাস হতে পারে না। প্রায় ঝড়ের মতন অদ্বিতীয়ার জীবনে এলো একজন। ঘর পোড়া গরু অদ্বিতীয়া নানাভাবে এই মানুষটিকে বোঝাতে চেষ্টা করলো নিজের থেকে দূরে রাখতে, নিজের জীবনের কোনও কথাই সে লুকোলো না। কিন্তু মানুষটির একটাই কথা কোনও কিছু আশা করে না সে, শুধু অদ্বিতীয়া থাকুক তার জীবনে ধ্রুবতারা হয়ে। মানুষটির জীবনেও আছে একলা থাকার যন্ত্রণা। তার জীবনে ক্ষণিকের প্রলোভনে পা হড়কানোর কথা সেও লুকায়নি অদ্বিতীয়ার কাছে। ব্যক্তিগত জীবনে ভুল স্বীকার করাই তার কাল হয়েছিল, আমাদের সমাজ ভুল বা অন্যায় লুকিয়ে রাখতে পারাটাকেই বাহবা দেয়, ভুল স্বীকার করা অপরাধ। সেই থেকে একাকী জীবন মানুষটার। অদ্বিতীয়া বা এই মানুষটা ভালো করেই জানে কোন একদিন জীবনের রিয়ালিটি চেকের মধ্যদিয়ে যেতেই হবে তাদেরকে। তারপরেও যদি এই সম্পর্ক টিকে যায় তবেই তারা একসাথে থাকবে কোন একদিন। জানে না কবে সেই দিন আসবে। তবে বেশ কিছু সময় পার করে দিয়েছে তারা স্বপ্ন দেখে দেখে। তারা এটাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের এই সম্পর্কের কারণে যেন কোন পরিবারের কেউই কষ্ট না পায়। অপেক্ষা করবে তার সঠিক সময়ের।

যখনি তাদের মধ্যে কথা হয়, সব কথা গিয়ে শেষ হয়, যখন সব দায়িত্ব শেষ হবে, যখন সামাজিক দায়িত্ব আর দেনা পাওনার হিসাবের বাইরে চলে যাবে তারা, তখন তাদের সেই যৌথ জীবনটা কেমন করে সাজাবে তারা! এই সমাজ কি ঝামেলা করবে? করলেও তখন আর তাদের তেমন কিছু এসে যাবে না।

স্বপ্ন দেখে পুরুষ, স্বপ্ন দেখে নারী, স্বপ্ন দেখে তারা, যদিও জানে যেকোনো সময়ই স্বপ্ন ভঙ্গের প্রবল বেদনাবোধের ভিতর দিয়ে যেতে হতে পারে। তবুও স্বপ্ন না থাকলে কিভাবে বেঁচে থাকা!

অদ্বিতীয়া আর তার কাছের মানুষটিও একসাথে স্বপ্ন দেখে, দূর থেকে হলেও পরস্পরের শক্তি হয়ে এই সংগ্রামমুখর জীবন পাড়ি দিতে চায়…অদ্বিতীয়া তার ছেলে মেয়েকে বলেছে তার এই আপাত নামহীন সম্পর্কের কথা! ছেলেমেয়েও অপেক্ষা করে থাকছে কোন একদিন মানুষটি সত্যি সত্যি তাদের মায়ের হাত শক্ত করে ধরবে, তারাও সে দিনের প্রতীক্ষা করে…

শেয়ার করুন: