রোজনামচা

women abstractলীনা হক: আজ সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে মনে হল হেঁটে যাই না কেন! অনেকদিন পরে হেঁটে অফিসে এলাম। বেশীর ভাগ সময়েই ঢাকার রাস্তায় অফিস টাইমে হাঁটা একটা বিড়ম্বনা ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা একদম ভিন্ন।

সকাল ৯টায়ও রাস্তা ফাঁকা ফাঁকা, বনানী ১০ আর ১১ নম্বর রাস্তার দোকান পাটের ঝাঁপি খুলতে এখনো অনেক দেরি। অনেক বাড়ী আর দোকানের সামনের রাস্তায়, গাছে জল ছিটানো হয়েছে, কিছু কিছু জায়গায় পাইপ বা বালতিতে করে ছিটাতেও দেখলাম। শুকনো মাটি দ্রুত শুষে নিচ্ছে। হালকা সোঁদা ঘ্রাণ আসছে। তবে রাস্তার ধুলো ভরা গাছগুলোকে দেখে কষ্ট লাগে। বাড়ীর মালিকেরা নিজের গাছের যত্ন নিচ্ছে কিন্তু রাস্তার গাছ গুলোকে দেখার কেউ নাই! সিটি কর্পোরেশন কি সপ্তাহে অন্তত একদিন বড় গাছগুলোতে জল দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না?

এইতো কদিন আগে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হল! বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত মনে হয় রাস্তার গাছেদের এই ধুলো ধুসরিত দৈন্য দশা কাটবে না! ফুলের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হল ফুলের সম্ভার যেন অনেক বেশী আজকে। যত্ন করে নেটের জামা পরিয়ে রাখা হয়েছে কিছু গোলাপ আর পদ্মকে। হলুদ গোলাপ যেন আলো করে আছে,পাশেই লাল গোলাপের তীব্রতাকে কিছুটা ব্যালান্স করছে সাদা গ্লাডিওলা। কিন্তু ফুলের বাস কেন পাই না! রঙ আর সাইজই আজকাল কাম্য, সুঘ্রাণ নয়! দেখি দুই কিশোরী ফুল হাতে নিয়ে দামাদামি করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে! এই এলাকার ফুলের দোকানগুলিতে কোন মূল্য ছাড়ের ব্যাপার নাই বলেই জানি। খুব মজা লাগলো ওদের কথা শুনে,’ একটু দাম কমালে কি হয় ভাই’! বেরসিক দোকানদারের কাঠখোট্টা উত্তর ‘ সকাল বইলা তবু এই দামে পাইতাছেন, দুপুরের পর আর এই দামে পাইবেন না। কাইলকা তো ডবল হইব দাম। ফুল না ও পাওয়া যাইতে পারে!’ মেয়েরা মনে হয় খবর রাখে না যে বেশী দামে বিকোবে বলে ফুলকুঁড়ির প্রস্ফুটিত হওয়াও এখন ফরমায়েশী। ফুলের বিকিকিনির ভাবালুতায় না জড়িয়ে অফিসের দিকে চলি!

আজ কি ঢাকা শহরকেও আমার মত আয়েশীভাব পেয়ে বসেছে! বনানী ব্রিজে কোন জ্যাম নাই, হাতে গোনা কিছু গাড়ী শাঁ করে চলে যাচ্ছে পাশ কাটিয়ে, হালকা টানে চলছে কয়েকটি রিকশা! ব্রিজের পায়ে চলার রাস্তায় অফিস চলতি মানুষেরও ঢল নাই আজকে! দু একজন যাচ্ছেন দ্রুত পায়ে, আমার দিকে কেউ আবার তাকান যেন আমি দিনের শুরুতে বৈকালিক ভ্রমনে বের হয়েছি! ব্রিজের উত্তর পশ্চিম দিকের হাঁটা রাস্তায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হল কিছু সময়। লেকের পাড় আর কিনারা ঘেঁষে সরু রাস্তা মনে হচ্ছে পরিষ্কার করা হয়েছে সম্প্রতি, কোথাও কোন ময়লা পরে নাই। লেকের জলেও কোন ময়লা, আগাছা পানা ভাসছে না। ওই পারে বনানীর স্কাই লাইনটা চমৎকার দেখাচ্ছে। দক্ষিণের বাতাস বোঝা যায়, হালকা কিন্তু শক্তিশালী, সরসরিয়ে উড়ে যায় রাস্তার ধুলো ময়লা, গাছের পুরনো পাতা ঝরে পড়ছে।

Leena Haq
লীনা হক

পাতা ঝরার বিষয়টা আমার খুব রহস্যজনক মনে হয়। অক্টোবরের দিকে যখন গাছের পাতা ঝরতে থাকে, কেমন এক ধরনের শীর্ণতা, খালি খালি ভাব। বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠা! ফেব্রুয়ারির পাতা ঝরা কেমন যেন আনমনা লাগে… লেকের পারের গাছ গুলোতে ধুলোর আস্তরন ভেদ করে নুতন সবুজ পাতার আভাস বোঝা যাচ্ছে… মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। হঠাৎই যেন বুঝে উঠি হেমন্ত আর বসন্তের পাতা ঝরার পার্থক্যের রহস্যময়তা। শীতের শুরুর পাতা ঝরার অনুভব অনেকটা জীবনের সেই সব ধুসর সময়ের মত, ক্লান্ত আর কোঁকড়ানোও হয়তো।

আর বসন্তের ঝরা পাতার ডালে উঁকি দেয়া উজ্জ্বল সবুজ নুতন পাতার আভাস যেন বলে দেয় জীবনের থেমে থাকা সময় আসলে থেমে থাকে না, স্থির সেই সময়গুলোতেও চলে প্রস্তুতি, ঠিক সময়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া। ছোট্ট এই জীবনে সুখে, দুঃখে, আনন্দ বেদনায়, সাফল্য ব্যর্থতায় কখনো হয়তো ধীর গতি হয়েছি কিন্তু থেমে থাকিনি। চলার এই আনন্দই জীবন।

শেয়ার করুন: