মারুফ রসূল: মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর প্রশ্নে সমাজের কেবল উদাসীনতাই নয়, অনেকক্ষেত্রেই লক্ষ্য করি বিষয়টির সংখ্যা হিসেবে অনেকেই নানা আপত্তিজনক কথা বলে থাকে। এক্ষেত্রে ডা. এম এ হাসানের গবেষণালব্ধ তালিকাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই এখানে তা সংযোজন করছি।
যদিও গবেষক স্বীকার করেছেন, এখানে তিনি সম্পূর্ণ হিসাব করতে পারেননি; সেটা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভবও না।
মাস নারী নির্যাতন – একদিনে এক মাসে
মার্চ ৫৯৭ জন ১৮৫২৭ জন
এপ্রিল ১১৬৬ জন ৩৫০০০ জন
মে ১০৩২ জন ৩২০০০ জন
জুন ৮৩৩ জন ২৫০০০ জন
জুলাই ৬৭৭ জন ২১০০০ জন
আগস্ট ৩৪৭ জন ১২০০০ জন
সেপ্টেম্বর ৫০০ জন ১৫০০০ জন
অক্টোবর ৬১২ জন ১৯০০০ জন
নভেম্বর ৪৬৬ জন ১৪০০০ জন
ডিসেম্বর ৩৫৪ জন ১১০০০ জন
একাত্তরে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের নিয়ে ডাব্লিউসিএফএফসি’র গবেষণা
১। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা: সাড়ে চার লাখেরও বেশি
ক. দেশের অভ্যন্তরে: দুই লাখ দুই হাজার পাঁচশত সাতাশ জন
খ. শরণার্থীদের মধ্যে: এক লাখ একত্রিশ হাজার দুইশত পঞ্চাশ জন (মার্চ-আগস্ট, ১৯৭১)
২। নির্যাতিত নারীদের ধর্ম
ক. মুসলমান: ৫৬.৫০%
খ. হিন্দু: ৪১.৪৪%
গ. খ্রিস্টান ও অন্যান্য: ২.০৬%
৩। নির্যাতিতা নারীদের বৈবাহিক পরিসংখ্যান
ক. বিবাহিত: ৬৬.৫০% এর চেয়ে বেশি
খ. অবিবাহিত: ৩৩.৫০% এর চেয়ে কম
গ. হিন্দু অবিবাহিত/কুমারী: ৪৪% এর চেয়ে কম
ঘ. যৌনদাসী, কমফোর্ট গার্ল (সেনাক্যাম্পে নির্যাতিতা নারীদের নাম) ও সন্তানসম্ভবা অধিকাংশ বীরাঙ্গনাই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। অধিকাংশ যুদ্ধশিশুর মায়েরাও ছিলেন তা-ই।
৪। নির্যাতনের ধরন
ক. স্পট ধর্ষণ ও স্পট গণ-ধর্ষণ: ৭০%
খ. ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন: ১৮%
গ. অন্যান্য অবস্থায় নির্যাতন: ১২%
৫। নির্যাতন পরবর্তী সময়ে নারীদের শারীরিক-স্বাস্থ্য সমস্যা
ক. শ্বেতস্রাব: ৮০% এর চেয়ে বেশি (কয়েক মাসব্যাপী)
খ. তলপেটে ব্যাথা: ৬৬% এর চেয়ে বেশি (কয়েক মাসব্যাপী)
গ. রক্তস্রাব: ৩৪% এর চেয়ে বেশি (কয়েক মাসব্যাপী)
ঘ. মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব (মেনোরেজিয়া): ২০% এর চেয়েও বেশি (দীর্ঘকালব্যাপী)
ঙ. ব্যাথাযুক্ত মাসিক (ডিসমেনোরিয়া): ৫০% এর চেয়েও বেশি (দীর্ঘকালব্যাপী)
৬। নির্যাতন পরবর্তী সময়ে নারীদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
ক. বিষাদগ্রস্ততা: ৮০% এর চেয়েও বেশি
খ. মাথা ব্যথা, অস্থিরতা, নৈরাশ্য ইত্যাদি: ৮০% এর চেয়েও বেশি
গ. গ্লানিতে ভোগা: ৯০% এর চেয়েও বেশি
ঘ. দুঃস্বপ্ন দেখেছেন: ৯০% এর চেয়েও বেশি
ঙ. মনোসম্পর্কিত দৈহিক রোগ: ৮০% এর চেয়েও বেশি
৭। স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন
নির্যাতনের স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রয়েছে শতকরা ৭ ভাগেরও কম নারীর। (ডাব্লিউসিএফএফসি ল্যাবে পরীক্ষিত)
৮। নির্যাতন পরবর্তী দৃশ্যপট
ক. স্বামী কর্তৃক লাঞ্ছিত বা পরিত্যক্ত: ৭% এর কম
খ. আত্মীয় বা পরিজন দ্বারা লাঞ্ছিত: ৯০% এর বেশি
গ. গ্রামের নির্যাতিতা নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীর সহানুভূতি পেয়েছেন
ঘ. শহর অঞ্চলের নির্যাতিত নারীরা অপেক্ষাকৃত কম সাপোর্ট পেয়েছেন
ঙ. গ্রামাঞ্চলে নির্যাতিতা নারীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবকিছু জানিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে।
চ. বিবাহিত নারীরা খুব কম ক্ষেত্রেই স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন।

এখানে একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে ধরা হলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশের মানুষের উপর আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে যে ভয়াবহ নির্যাতন করেছে- তা পৃথিবীর ইতিহাসে, সভ্যতার ইতিহাসে এক কালিমা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি ঘটনারই নির্যাতন ও সাহসিকতার স্মারক আছে। মুক্তিযুদ্ধে একদিকে নারী যেমন নির্যাতিত হয়েছেন চূড়ান্তরূপে, নিকষ কালো রাত্রির মতো করা হয়েছে তাকে অপমান; তেমনি, এই নারী সমাজই বিপন্নতার মরাগাঙে এনেছিলেন বিপ্লবের খরস্রোত। নির্মাণ করেছিলেন প্রতিরোধের সৌধ, জ্বালিয়েছিলেন উদ্ধত অহঙ্কারের পবিত্র দীপাবলী।