ফাহিমা কানিজ লাভা: বেগম রোকেয়া, মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনি খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন সমাজের একটা বড় অংশ নারীদের উন্নয়ন ব্যতিরেকে একটি সমাজ ও দেশের উন্নতি অসম্ভব।
পুরুষশাসিত রক্ষণশীল সমাজে নারীর প্রতি সকল নিষ্ঠুরতা, অন্যায়-অবিচার, কুসংস্কার, অশিক্ষা ও ধর্মের বেড়িতে বন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য করা নারী সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে, মুক্তির স্বাদ নিতে, পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনে আগ্রহী করতে তিনি আমৃত্যু লড়েছেন।
রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন।
শিক্ষাই যে নারীমুক্তির সোপান- তা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। শারীরিক ও মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে উনি বলেছিলেন-‘মুক্তির উপায় ঐ শিক্ষাবিস্তার। যদি মনে দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে সুশিক্ষালাভই আধ্যাত্মিক মুক্তির উপায়, তবে শিক্ষার পথে যতই কণ্টক থাকুক না কেন, বিশ্বাসীগণ (বিশ্বাসীনী) তাহা উৎপাটন করিতে করিতে অগ্রসর হইবেই।’ “কোন বস্তুই ইচ্ছামাত্রে প্রাপ্ত হওয়া যায় না; তাহার জন্য পরিশ্রম করিতে হয়। আমরা জ্ঞানপিপাসা অনুভব করা মাত্রই কেহ সুধাভাণ্ড হস্তে আমাদের ঘরে ঘরে উপস্থিত হইবে না। তৃষ্ণার্তের নিকট কূপ আইসে না- পিপাসীকে কূপের নিকট যাইতে হয়।” শিক্ষা অর্জনের জন্য সকল বাঁধাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে, তিনি তা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
বেগম রোকেয়া শিক্ষা নিয়ে তার সুচিন্তিত মতামত দিয়েছিলেন, বলেছিলেন-“যাহা হউক, ‘শিক্ষার’ অর্থ কোনো সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের “অন্ধ অনুকরণ” নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (Faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। ঐ গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ, মনঃ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত দ্বারা সৎ্কার্য করি, চক্ষু দ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন (বা Observe) করি, কর্ম দ্বারা মনোযোগ পূর্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তা-শক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি-তাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল “পাশ করা বিদ্যা”কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।” অথচ এখনো আমাদের সমাজের অধিকাংশই শিক্ষাকে পুঁথিতেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, শিক্ষাকে চাকরিলাভের সনদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
পুঁথিগত বিদ্যার্জন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয়, তাই তিনি বলেছিলেন- ‘আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে (নারীদের) নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে।‘ তিনি নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন-“কন্যার বিবাহের সময় যে টাকা অলংকার ও যৌতুক ক্রয়ে ব্যয় করেন, তাহারই কিয়দংশ তাহাদের সুশিক্ষা ও স্বাস্থ্যরক্ষায় ব্যয় করুন।”
১৯০৯ সালে ভাগলপুরে রোকেয়া ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার ফলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। এখানে ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল পুনরায় চালু করেন।প্রাথমিক অবস্থায় ছাত্রী ছিল ৮ জন। চার বছরে ৮৪ জনে হয়ে যায়। ১৯৩ সালের মাঝে এটি হাই স্কুলে পরিণত হয়। বর্তমানে স্কুলটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ।
নারী শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত প্রাণ রোকেয়ার সাথে প্রয়াত মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের লেখায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কারের চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়৷ পর্দার আড়াল থেকেই রোকেয়া জনাব নাসির উদ্দীনের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন৷ এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস না করে পারলেন না,
“আপনি প্রগতিপন্থী মহিলা অথচ পর্দার ভিতরে থেকেই কথা বলছেন?” এর উত্তরে রোকেয়ার আজীবন বাহ্যিক অর্থে পর্দা মেনে চলার সপক্ষে তাঁর বক্তব্য ছিল এমন- “পর্দা মানে অবরোধ নয়, কিন্তু আমি যে অনিচ্ছাকৃতভাবে অবরোধবাসিনী হয়েছি তার কারণ অনেক৷ আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়৷ একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়মকানুনগুলিও পালন করছি৷
… স্কুলের জন্য মেয়ে আনতে যাই, কিন্তু অভিভাবকরা আমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেন পর্দা পালন করা হয় কিনা?… স্কুলের জন্য আমি সমাজের সব অবিচার অত্যাচার সহ্য করে চলেছি৷” নারীশিক্ষার বিস্তারে তাঁর এমন অনেক আত্মত্যাগ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
নারীরা যেন অন্ন-বস্ত্রের জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল না হয়, সেজন্য তিনি নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন-“আমরা উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কী হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।”
১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া বিধবা নারীদের কর্মসংস্থান, দরিদ্র অসহায় বালিকাদের শিক্ষা, বিয়ের ব্যবস্থা, দুস্থ মহিলাদের কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ, নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞানদান, বস্তিবাসী মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম মুসলিম মহিলা সমিতি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’। তৎকালীন বাংলার পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত মুসলিম নারীদের গৃহকোণের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নারী উন্নয়নের ইতিহাসে এই সমিতির অবদান অপরিসীম।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত শামসুননাহার মাহমুদ রচিত রোকেয়া জীবনী গ্রন্থের ‘মুসলিম বঙ্গে নারী আন্দোলন’ অংশে, ভয়ঙ্করভাবে প্রতিকূল বিপ্রতীপ অবস্থার মধ্যেও রোকেয়া কিভাবে তাঁর স্কুল বা সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীন ইসলাম বাঙ্গলা’র কাজকর্ম পরিচালনা করতেন সে-বিষয়ে বেগম মাহমুদ রোকেয়ার সরস কৌতুকপূর্ণ অথচ দৃঢ়চেতা মনোভাব তুলে ধরেছেন- “তখন একবার বাহির হইতে অকারণে সামান্য বিরুদ্ধ সমালোচনা শুনিয়া একটু বিচলিত হইয়াছিলাম, সে সময়ে তিনি হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা গ্লানি, উপেক্ষা, অপমান কিছুতে তাহাতে আঘাত করিতে না পারে; মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যে ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে৷’
তিনি নারী ও পুরুষের সমতা চেয়েছিলেন, সমাজে নারী ও পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে যাবে, দেশ গঠনে অবদান রাখবে-এটাই তার স্বপ্ন ছিল। তিনি পুরুষদের সমান হতে বলেছেন, কিন্তু পুরুষদের উনি কখনোই ছোট করে দেখেননি। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোড়াইয়া খোড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই। শিশুর জন্য পিতামাতা উভয়েরই সমান দরকার।
… আমাদের উচিত যে, তাঁহাদের সংসারে এক গুরুতর বোঝা বিশেষ না হইয়া আমরা সহচরী, সহকর্মিণী, সহধর্মিণী ইত্যাদি হইয়া তাঁহাদের সহায়তা করি। আমরা অকর্মণ্য পুতুল-জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত’। বলেছিলেন-‘সমাজের অর্ধবঙ্গ বিকল রাখিয়া উন্নতি লাভ অসম্ভব।’ ‘দেহের দুটি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সবরকমের কাজকর্মের প্রয়োজনেই দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান।’
নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তির ধারণাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল বেগম রোকেয়ার জীবনের ব্রত। তিনি শুধু সাহিত্যিক নন, সমাজ-সংস্কারকও বটে। সমাজে নারীর মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি বিভিন্নভাবে কাজ করে গেছেন যার সুফল নারীরা এখনো পাচ্ছে। যদিও এখনো সমাজে নারীদের অনেক পশ্চাৎপদতা ও নির্যাতন সহ্য করতে হয় তবুও সমাজের সর্বস্তরে বেগম রোকেয়ার আদর্শকে বাস্তবায়ন করা গেলে নারীমুক্তি সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। আর নারীমুক্তির হাত ধরেই আসবে দেশ ও জাতি তথা সারা বিশ্বের সমৃদ্ধি।
মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।