‘কর্মমুখী’ কারিগরি শিক্ষাই পারে বিপুল জনগোষ্ঠীর পতন ঠেকাতে

রাজনীন ফারজানা:

বার্ডস আই ভিউ বলে একটা কথা আছে। এর মানে পাখির চোখে দেখা। চোখের সামনে অনেককিছু বুঝতে পারবেন না, কিন্তু যখন উপর থেকে দেখবেন তখন পরিষ্কার ভিউ পাবেন। আমার কাছের লোকজন জানে আমি কেমন দেশপাগল। সবাই দেশ ছাড়তে চাইলেও আমি কখনো ছাড়তে চাইনি। এখন যখন বাইরে আসছি অনেককিছু উপর থেকে দেখে ক্লিয়ার হচ্ছে। আপনারা যখন দেখছেন উন্মাদ নির্বোধ বাঙ্গু জনতা আবারও মব ভায়োলেন্স তৈরি করে অস্থিরতা তৈরি করছে। আমার হাসি পাচ্ছে, দু:খ লাগছে। বহির্বিশ্বের তরুণ মিলেনিয়াল আর জেন জিরা ফেসবুকে এক্টিভ না, তাই নিজের দেশ নিয়ে অ্যামবারেসড হওয়া লাগবে না ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি। টিকটক, ইনস্টা, স্ন্যাপচ্যাটে ভিডিও গেলে অবশ্য আর লজ্জা বাঁচানোর ভরসা নাই। কারণ পাকিস্তানেও দুইদিন পরপর এসব মব সহিংসতার ঘটনা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই দেখি। যাই হোক, নিজের জাতীয়তা তো বদলাতে পারবো না।

ভদ্রতা, শিষ্টাচার, গণ পরিসরের আচরণ, সভ্য আচরণ এসব শেখাতেও আমরা ব্যর্থ। এসব ছাপিয়ে আমি আসলে ভাবি এতো বিরাট সংখ্যক তারুণ্যের অপচয়। এখানে অর্থনীতির ছাত্ররাও দেখি বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক তরুণের কথা জানে। কিন্তু ওদের বলতে পারি না এই বিপুল তারুণ্যকে কীভাবে নষ্ট করে ফেললাম আমরা। রাজনৈতিক সহিংসতা, ব্যক্তিতান্ত্রিক উন্নয়ন ধারণা ও তা থেকে উদ্ভুত দুর্নীতির ফলে আমরা সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনাই করিনি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে সুযোগ থাকার পরেও তারা শিক্ষায় বিনিয়োগ করেনি। অথচ এই একটা খাতের সামান্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি আর কারিগরি শিক্ষায় জোর দিলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা লক্ষ্য থাকতো সামনে আগানোর। দেখুন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কিছু না কিছু মাধ্যম লাগে। রিটায়ারমেন্টের পর বাড়ি, শীতের ছুটিতে কক্সবাজার টাইপের লক্ষ্যও একটা মাধ্যম। আপনি ওইটুকু পাওয়ার জন্য সারাবছর বা সারাজীবন কাজ করেন। শুধুমাত্র মরার পরের জীবনকে টার্গেট করে কেউ বাঁচে না। যারা ধর্মগুরু তারাও না। যদি করতো তারা তাহলে নিজেরা মুমিনের মতো জীবন কাটাতো। কিন্তু তারা মোনাফেকি করে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে পরকালের মূলা ঝুলায়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে।

আপনি ধর্মীয় শিক্ষা নেন বা একাডেমিক শিক্ষা, দুনিয়ায় যেহেতু বেঁচে থাকতে হবে টাকা উপার্জন আপনাকে করতেই হবে। বড়লোক বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মাদ্রাসায় পড়লেও তারা পরবর্তীতে অন্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেয়। ব্যবসা বা অন্যান্য চাকরি করে। কিন্তু গরীব যে শিশু মাদ্রাসা বা এতিমখানায় যায় তার আসলে ভবিষ্যত থাকে না। অন্যরা বড় হয়ে ছাত্রলীগ/ছাত্রদলের মতো সংগঠনের সদস্য হয়। আর সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা অত্যন্ত ছোট বয়স থেকেই ধর্মীয় রাজনীতির অনুসারী হিসেবে গড়ে ওঠে। টেকনিক্যাল বা আধুনিক শিক্ষা না থাকায় তারা অন্য পেশাতেও পিছিয়ে থাকে। তার বয়সী অন্য শিশু যেখানে জাভা, পাইথন শিখতেছে এসব শিশু কিশোরদের একমাত্র রেফারেন্স পয়েন্ট ধর্মগ্রন্থ ও তার নানামুখী তাফসির। ধর্মগ্রন্থগুলো যতটা শান্তিপূর্ণ, এর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে সেটা কতটা মারণাস্ত্র হতে পারে তা আমরা বর্তমান দুনিয়ায় দেখতে পারছি।

বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রেই দেখা যায় কুরআন বা হাদিসের বাণী পড়ে কেউ হয় আল্লাহভিরু মুসলমান আর কেউ হয় খুনে মানসিকতার জঙ্গি ভাবাপন্ন। একই কথা হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি সব ধর্মের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখন সমস্যা শুধু ধর্মীয় শিক্ষার না। এখানে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই একটা স্ক্যাম। একটা সমাজের সবার অনার্স, মাস্টার্স করার দরকার নাই। যারাই অল্টারনেটিভ পথ বেছে নিয়েছে এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিজিওথেরাপি, নার্সিং, টেকনিশিয়ান, কম্পিউটার শিক্ষার দক্ষতা অর্জন করেছে, তারা কিন্তু কেউ বসে থাকে না। ড্রাইভিং শিখে কাউকে বসে থাকতে দেখবেন না। যারা লেখাপড়া জানে না তারাও হেলপারি করে করে ড্রাইভারিটা শিখে নেয়, কারণ এই কর্মদক্ষতা ওকে কাজ দেবে ভবিষ্যতে। এবং এই দক্ষতাটা যদি কেউ বৈজ্ঞানিক উপায়ে শেখে তাহলে তা সে দেশের বাইরেও কাজে লাগাতে পারবে।

ধরেন আপনি খুব ভালো টাইলস মিস্ত্রি। মানে আন্দাজে না একদম অংকের হিসাবনিকাশ করে টাইলসের কাজ বোঝেন। সঙ্গে যদি আপনার ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা থাকে আপনি দেশের মধ্যেই বড় বড় প্রোজেক্ট পাবেন। আপনার যদি দক্ষতার ওপর সার্টিফিকেট থাকে ও আপনি ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষাটাও জানেন, আপনি একজন দক্ষ মানুষ হিসেবে বিদেশে আসতে পারবেন।

তবে এই সংখ্যাটাও আশংকাজনকভাবে কমছে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডিজিটাল অভিবাসন প্ল্যাটফর্ম ‘আমি প্রবাসী’র বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৪ এ সেকথাই উঠে এসছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা ২৭ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালে যেখানে প্রায় ১৪ লাখ (১৩,৯০৮১১) গেলেও ২০২৪ সালে বিদেশ যায় দশ লাখ (১০,০৯,১৪৬) জন বাংলাদেশি কর্মী। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দক্ষ কর্মী তৈরির অন্যতম মাধ্যম, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তির সংখ্যা কমা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারিগরিতে ২০২৪ সালে ১ লাখ ১২ হাজার ১৬৬ জন ভর্তি হয় যা আগের বছর ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ২৭০ জন। যা অর্ধেকেরও কম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই তারুণ্য যাচ্ছে কোথায়? নিশ্চয়ই তারা সাধারণ শিক্ষা বা মাদ্রাসায় ফিরে যাচ্ছে না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা দৈনিক মজুরি, রিকশা চালানোর কাজে যুক্ত হচ্ছে অথবা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। কারণ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির আসলে যাওয়ার আর জায়গা থাকে না। সচেতনতা না থাকায় এসব মানুষকে সহজেই ভুল পথে পরিচালিত করা যায়।

সমস্যা হচ্ছে সবাইকে আইএ, বিএ পাস হওয়ার সেই ব্রিটিশ আমলের গর্বের চিহ্ন হিসেবে আজও আমরা শিক্ষাকে ভুল পথে পরিচালিত করছি। এখানে কোন পরিকল্পনা নাই। যে অংক পারে না সে হয় অংকের শিক্ষক, যে সমাজ, পৌরনীতি, রাষ্ট্রনীতি বোঝে না সে গিয়ে বাচ্চাদের সমাজবিজ্ঞান পড়ায়। মুখস্ত করতে দিয়ে ক্লাসরুমে ঘুমায়। এতে আমরা দীর্ঘ দশবছর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজবিজ্ঞান পড়িয়েও সভ্য নাগরিক তৈরি করতে পারি না। ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা হলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর মানুষ ইংরেজি ভাষাটাকে রীতিমতো ভয় পায়। অন্যান্য ভাষায় তো দক্ষতা অর্জন করেই না।

এদিকে যারা করে তারা কিন্তু বসে থাকে না। কোন দক্ষতা অর্জনই বৃথা যায় না। অনলাইনে হোক, বাইরে যেয়ে হোক, নিজে উদ্যোক্তা হয়ে কিছু না কিছু কাজ তারা করেই। অন্যদিকে হাজার হাজার এমএ, বিএ’র কোন কাজ নাই। এসব তো কর্মমুখী শিক্ষা না, এতো এতো গ্রাজুয়েট, পোস্ট গ্রাজুয়েট দিয়ে কাজ নাই তো! বাংলা, ইংরেজি, সমাজ, অংক, পদার্থের মতো সাবজেক্ট পড়ে শিক্ষক হওয়া যায়। কিন্তু আমাদের কারিকুলাম ডিজাইন সেরকম না। ফলে গাদা গাদা সাবজেক্টের গ্রাজুয়েট আর পোস্ট গ্রাজুয়েট আসলে সার্টিফিকেটধারী বেকার আর কম বেতনের কামলা ছাড়া কিছুই বানাতে পারছে না।

এখন আপনি যে শিক্ষাতেই শিক্ষিত হোন, যখন কাজের মধ্যে থাকবেন তখন আসলে আপনার দুনিয়ার সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় আসবে না। রিয়াক্ট করা তো অনেক দূরের চিন্তা। সুস্থ ও সুন্দর চিন্তার মধ্যে থাকলে ও ঘৃণার বাণী না শুনলে আপনিও মানবিক মানুষ হবেন। আপনার প্রতিবাদের ভাষা হবে সভ্য। আপনাকে তখন লোকে গুরুত্ব দেবে। আপনার কথা শুনবে। কিন্তু আপনারা যখন যুক্তিতর্ক, ভব্যতা-সভ্যতার ধার না ধেরে শুধু অন্ধ আক্রোশ আর রাগ দেখান, তখন আর মানুষ আপনাদের সিরিয়াসলি নেয় না। কিন্তু এটা বোঝানোর মতো মানুষ নাই খুব একটা।

আমি বা আমার মতো দুয়েকজন বললে নানা ট্যাগে ট্যাগায়িত করে কেউ আসবো জান নিতে, কেউ আসবে গালি দিতে। যারা সচেতন বাবা-মা, তারা রিয়েলিটি বোঝার চেষ্টা করুন।

ট্রাস্ট মি, বাংলাদেশের এসব প্রতিবাদ, প্রতিরোধে কিছুই যায় আসে না। বিশ্বের আর কোন মুসলিম দেশের মানুষ এগুলো করে না। অন্যদের প্রতিবাদের ভাষা সভ্য, দক্ষিণ এশিয়ানদের মতো এত ভায়োলন্ট না। পুরো দেশের চিন্তা না করে আপনি নিজ নিজ সন্তানকে যদি দুনিয়ায় কিছু করে খাওয়ার ও ঘৃণাজীবী না হওয়ায় শিক্ষা দেন, তাতেও লাভ হবে। একশটা ঘৃণাজীবীর মধ্যে দশজন মানবিক মানুষ থাকলেও লাভ। আমাদের বাবা-মায়েদের সচেতনতাই পারে দুনিয়ার বুকে ছোট্ট এই দেশটাকে মাথা উঁচু করে টিকায়ে রাখতে।

 

লেখক পরিচয়: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, ভ্রিজ ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলস (ভিইউবি)

শেয়ার করুন: