পারভেজ হত্যাকাণ্ড: কাঠগড়ায় নারী, আড়ালে আসল অপরাধী?

সুমিত রায়:

এক নিমিষের হাসি কেড়ে নিলো একটি জীবন। পারভেজের মৃত্যু আমাদের সমাজকে যেন এক হিমশীতল আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ঘটনার পরতে পরতে যে আলোচনা উঠে আসছে, তা কেবল বেদনার নয়, গভীর এক অসুস্থতারও ইঙ্গিত দেয়।

মূল হত্যাকারী একজন পুরুষ, কিন্তু সামাজিক আলোচনার তীর ঘুরে যাচ্ছে সেই মেয়েটির দিকে, যার একটি ফোনকলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে সব ক্ষোভ আর ঘৃণা। ছেলেটি ক্ষমা চেয়েছিল, মাথা নিচু করেছিল, তবু রক্ষা পায়নি। কেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখছি, আঙুল উঠছে মেয়েটির ‘ইগো’ বা ‘নিষ্ঠুরতা’র দিকে। কিন্তু আসল প্রশ্নটি কি হারিয়ে যাচ্ছে না এই গোলকধাঁধায়? কেন একজন নারীর অভিজ্ঞতা জানানোর সরল কাজটি আজকের সমাজে তাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়?

প্রথমেই যে বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির অসঙ্গতি, তা হলো শিকারকেই দোষারোপ করার সংস্কৃতি বা ভিক্টিম-ব্লেমিং। যদিও পারভেজ এখানে সরাসরি শিকার, কিন্তু ঘটনার অনুঘটক হিসেবে মেয়েটিকে যেভাবে দায়ী করা হচ্ছে, তা এই সংস্কৃতিরই ভিন্ন রূপ। নারীবাদী তাত্ত্বিক সুজান ব্রাউনমিলার তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Against Our Will’-এ দেখিয়েছেন, সমাজ প্রায়শই নারীর আচরণ, পোশাক বা অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়কে লঘু করে দেখে বা কখনও কখনও পরোক্ষভাবে বৈধতা দেয়। এখানে মেয়েটি হয়তো সরাসরি যৌন হেনস্তার শিকার হয়নি (অথবা ভুল বুঝেছে), কিন্তু তার অভিজ্ঞতা জানানোর পর যে ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটলো, তার জন্য তাকেই দায়ী করার প্রবণতা এই ভিকটিম-ব্লেমিং সংস্কৃতিরই অংশ। সমাজ যেন বলছে, “তুমি কেন বলতে গেলে? তোমার বলার কারণেই তো ছেলেটা মারা গেল!” এই যুক্তির ফাঁদে ফেলে মূল অপরাধীর দায় হালকা করে দেওয়া হয়। এমনকি মেয়েটি যদি ভুলও বুঝে থাকে, সেই ভুল বোঝা কি হত্যার মতো অপরাধের জন্ম দিতে পারে? আর সেই ভুল বোঝার দায় কি কেবলই তার?

এই ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক সময় সমাজে এক ধরনের নৈতিক আতঙ্ক (Moral Panic) তৈরি হয়, যেমনটি ব্যাখ্যা করেছেন স্ট্যানলি কোহেন – সমাজ অনেক সময় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে “লোকায়ত শয়তান” বা folk devil হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সমস্ত সামাজিক অস্থিরতা বা অপরাধের দায় তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। পারভেজের হত্যাকাণ্ডের পর মেয়েটি যেন সেই ‘ফোক ডেভিল’-এ পরিণত হয়েছে। মূল খুনি বা খুনের কারণগুলোকে বিশ্লেষণের চেয়ে মেয়েটির ফোন কল বা তার অনুভূতি প্রকাশকেই সমস্ত সমস্যার মূল হিসেবে দেখানো হচ্ছে। মিডিয়া এবং সামাজিক আলোচনা যখন একদিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন এই নৈতিক আতঙ্ক আরও তীব্র হয় এবং মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরে যায়।

কেন একজন নারী তার অভিজ্ঞতার কথা জানালে কিছু পুরুষ এতটা হিংস্র হয়ে ওঠে, কেন তাদের ভেতরের পৌরুষের বোধ এতটা তীব্রভাবে আহত হয়? এই জটিল প্রশ্নের গভীরে আলো ফেলেন সমাজতাত্ত্বিক মাইকেল কিমেল (Michael Kimmel) তাঁর ‘পুরুষালী ভঙ্গুরতা’ বা মেল ফ্র্যাজাইলিটি নামক ধারণাটি দিয়ে। কিমেল অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, সমাজে পুরুষদের ওপর শক্তিশালী, নিয়ন্ত্রক এবং কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়ার এক অদৃশ্য কিন্তু প্রবল চাপ থাকে। তাদের শেখানো হয়, আবেগ (বিশেষত দুর্বলতার) প্রকাশ করা পুরুষোচিত নয়, বরং ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাই আসল পৌরুষ। যখন এই প্রত্যাশিত ক্ষমতার কাঠামো সামান্যতম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে—হোক তা নারীর একটি স্বাধীন মত, একটি অভিযোগ, তার প্রতি হওয়া কোনো অন্যায়ের বিবরণ, বা এমনকি তার নিজের কোনো অস্বস্তির প্রকাশ—তখন কিছু পুরুষের পুরুষত্বের ধারণাটি এতটাই ঠুনকো প্রমাণিত হয় যে, তারা নিজেদেরকে মারাত্মকভাবে অসুরক্ষিত ও হুমকির মুখে মনে করে। তাদের মনে হয়, তাদের কর্তৃত্বের ভিত নড়ে যাচ্ছে, তাদের সম্মানহানি হচ্ছে। পারভেজের ঘটনার ক্ষেত্রেও এটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। মেয়েটি যখন তার বয়ফ্রেন্ডকে ঘটনাটি জানায় (হোক তা ভুল বোঝাবুঝি বা সত্যি), তখন ছেলেটির কাছে এটি কেবল একটি সাধারণ অভিযোগ ছিল না। এই ঘটনা তার পুরুষালী অহংবোধে, তার কর্তৃত্বের বা রক্ষাকর্তা হিসেবে তার ভূমিকার ধারণায় সরাসরি আঘাত হেনে থাকতে পারে। তার প্রেমিকার প্রতি করা (কথিত) আচরণকে সে নিজের প্রতি পরোক্ষ অপমান বা নিজের নিয়ন্ত্রণহীনতার প্রমাণ হিসেবে দেখে থাকতে পারে। এই ‘পুরুষালী ভঙ্গুরতা’র কারণেই তার প্রতিক্রিয়া হয় চরম ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজের ভেতরকার এই গভীর নিরাপত্তাহীনতা এবং পুরুষত্বের নড়বড়ে ভিতটাকে ঢাকার জন্য, ক্ষুণ্ণ হওয়া ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এক মরিয়া চেষ্টায় সে বেছে নেয় চরমতম সহিংসতার পথ। এই হিংস্রতা আসলে তার ভেঙে পড়া পৌরুষকে জোড়া দেওয়ার এক বিকৃত, ভয়াল প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। সামান্য আঘাতে যে পৌরুষ এতটা আহত হয় এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখতে অন্যের জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো চরম পথে ধাবিত হয়, তা আদতে কতটা ভঙ্গুর, কিমেলের তত্ত্ব আমাদের সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একইসাথে, এই ঘটনা বিষাক্ত পৌরুষ (Toxic Masculinity) এর এক ভয়াল প্রকাশ। যখন মেয়েটি তার বয়ফ্রেন্ডকে ঘটনা জানায়, তখন ছেলেটির মধ্যে থাকা ‘রক্ষাকর্তা’ বা ‘নিয়ন্ত্রক’ হওয়ার পুরুষতান্ত্রিক ধারণাটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন এবং প্রেমিকার ‘অপমান’-এর প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা তাকে এমন এক আগ্রাসী পথে চালিত করে, যার শেষ হয় একটি প্রাণের বিনাশে।

মেয়েটি হত্যার নির্দেশ দেয়নি, তার একটি কাজ ঘটনাটির শৃঙ্খলকে গতি দিয়েছে মাত্র। তবে তাকে যেভাবে ঢালাওভাবে দায়ী করা হচ্ছে, তা সমাজের গভীরে প্রোথিত নারীবিদ্বেষ এবং বিচারবুদ্ধির অভাবকেই স্পষ্ট করে। পারভেজের হত্যাকাণ্ড এক ট্র্যাজেডি, কিন্তু সেই ট্র্যাজেডির বিচার করতে গিয়ে যদি আমরা আসল অপরাধীকে আড়াল করে একজন নারীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই, তবে তা হবে আরও বড় সামাজিক বিপর্যয়। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে নিজেদেরকেই—কেন আমরা এত সহজে মূল অপরাধীকে পাশ কাটিয়ে যাই? কেন নারীর প্রতিটি পদক্ষেপ আতসকাঁচের নিচে ফেলে বিচার করি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজলে পারভেজদের মৃত্যু হয়তো ঘটতেই থাকবে, আর আমরা আঙুল তুলতেই থাকব ভুল মানুষের দিকে।

#IfYouAskUs
#BdFeministThoughts
#WhatAreBdFeministsThinking
#WomanUnite

শেয়ার করুন: