দলান্ধের ইনসমনিক পদ্মলোচন

মাসকাওয়াথ আহসান:

চোখের সামনে হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার জন্মদিনে বড্ড ট্রেন্ডি মিলেনিয়াল সেজে পথশিশুদের কেক খাওয়াতে আসা ললিতা আপা হয়েছে আমাদের প্রগতিশীলতার প্রতীক; আর শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার এস আলমের শারিয়া বোর্ডের সদস্য শরিয়ত ভাই বড্ড ট্রেন্ডি মোল্লা সেজে হয়েছে আমাদের ইসলামশীলতার প্রতীক। এইভাবে সাড়ে পনেরো বছর ধরে খাল ভরাট করে সুরের ধারা বইয়ে দিয়ে সেকুলারিজমের ফুট সোলজার তৈরি করেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা; আবার খাসজমিতে সুরার ধারা বইয়ে দিয়ে ইসলামপন্থার ফুট সোলজার তৈরি করেছে স্বৈরাচারী হাসিনা কাল্ট।

ভারতের গদি মিডিয়ার উত্তেজিত ময়ূখ ঠিক যেভাবে বাংলাদেশকে চিত্রায়িত করে; সুরার ধারা ঠিক সেই চিত্রনাট্য অনুযায়ী খেলাফতের জুজু দেখায়; ঐ জুজু দেখে সুরের ধারা কাঁপাকাঁপির ছলনা করে। যৌথ নদীতে বাঁধ-ব্যারেজ-জলাধারের স্লুইস গেট হঠাত হঠাত খুলে দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত করে মোদি প্রশাসন। সুরার ধারার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই; তার রয়েছে এস আলমের চর্বি আর খাসজমির ওপর গড়ে তোলা মাদ্রাসার ফুট সোলজার। তার বিরাট বিরাট চিন্তা। শিরক, ইমান, তাওহীদ, সমকাম, শরিয়ার বিশুদ্ধতা। সুরের ধারা তো কালে ভদ্রে বুবুর জন্মদিনে পথশিশুকে কেক খাওয়াতে গেলে তার গরিবের কথা মনে পড়ে। বাকি সময় সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা করে; বুবুই পারে, বুবুই পারবে আলাপটাকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির প্রলাপটার সঙ্গে জুড়ে আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, সমকাম, বিশুদ্ধ হাসিনা কাল্টের চর্বি সর্বস্ব গোলাপে কাটায়।

এই যে সারাক্ষণ কালচারাল ওয়ার করা যে সুরের ধারা ও সুরার ধারাকে আপনি নিয়মিত ঘেউ ঘেউ করতে দেখেন; এটাই তাদের পেশা-জীবন ও জীবিকা। একটা জায়গায় এদের মিল; এরা অত্যন্ত খারাপ ছাত্র-ছাত্রী। যৌক্তিক কোন চিন্তা করার ক্ষমতা এদের নষ্ট হয়ে গেছে গত শত পনেরো বছর বছর ধরে বুবুর সুরে সুর মেলাতে মেলাতে। বুবু হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে গান বাংলার তাপসের দাড়িতে পুষেছেন; বুবু ইসলামি সংস্কৃতিকে পুষেছেন শাফি মোল্লার দাড়িতে। এই কালচারাল বানর খেলার রিং মাস্টার বুবু; এখন মোদি প্রশাসনের অর্কেস্ট্রার পার্কে বাদাম খান; ঘোরাঘুরি করেন।

অধ্যাপিকা সামিনা লুৎফা যখন হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন; তখন সুরের ধারার বাঁদরগুলো তার প্রগতিশীলতার পৈতে কেড়ে নিয়েছিলো। আবার সুরার ধারার বাঁদরগুলো সামিনাকে ইসলামবিদ্বেষীর তকমা দিলে সুরের ধারার বাঁদরগুলো এসে সামিনার বাগানের বাতাবি গাছের ডালে বসে, এসো এসো সুরে করুণ মিনতি মাখা। উপস্থাপক পিতম যখন হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়েছিলো তখন সুরের ধারার লোচনগুলো তাকে শিবিরের তকমা দিয়েছিলো। সুরার ধারা লোচনগুলো তাকে মাথায় তুলে নেচেছিলো। পিতম বহুচিন্তা বহু প্রেফারেন্সের মানুষের উপস্থিতিতে অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজের কথা বললে; সুরের ধারা অশ্রুসিক্ত হয়ে বলে, পিতম, ও পিতম তুমি শাহবাগে এসে এস্রাজ বাজাও না কেন; আমরা মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করবো। সুরার ধারা তখন রেগে কাঁই হয়ে পিতমকে প্রকৃষ্ট শাহবাগী নাশতেক ডাকতে থাকে।

এই হচ্ছে আমাদের পলিটিক্যাল ফ্রগ বিজনেসের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মোল্লা ফ্রগ ও ইসলামি চেতনা মোল্লা ফ্রগের সম্মিলিত আইকিউ সেভেন্টি ফোর লীগ। এদেরকে আমরা গুরুত্ব দিই। গুরুত্ব দিয়ে মাথায় তুলি।

শহীদ মুগ্ধের মায়ের নামে মেটিকিউলাস গুজব ছড়িয়ে সুরের ধারা ফ্রগ ঘ্যাংর ঘ্যাং করে। দুগাছা ফুরফুরে দাড়ি নিয়ে সুরার ধারার ফ্রগ সামাজিক পুলিশির ঘ্যাংর ঘ্যাং করে। শরীরে বুবুর বেনিফিশিয়ারি হবার চর্বি; সুরের ধারার ফ্রগের মনে বুবুর প্রকল্প হারানোর শোক; সুরার ধারার ফ্রগের মনে নতুন সরকারের সামনে দলভারী ফ্রগ গ্যাং দেখিয়ে নতুন প্রকল্প বাগানোর চেষ্টা । যেভাবে বুবুর সরকারের শুরুতে সুরের ধারা গ্যাং দলভারী দেখিয়ে প্রকল্প বাগিয়েছিলো। এই ফ্রগ বিজনেসটা ডিএনএ-তে থাকে। বৃটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ডিএনএ সুরের ধারায় রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে আওয়ামী লীগের চাটার দল হয়েছে। আর পাকিস্তানের অল্পস্থায়ী বন্দোবস্তের ডিএনএ সুরার ধারায় হামদ-নাত গেয়ে জামায়াতের ফাটার দল হয়েছে।

এই দুই ফ্রগ গ্যাং খুবই ফরোয়ার্ড লুকিং; আওয়ামী ফ্রগেরা পনেরো বছরের গুম-খুন-ক্রস ফায়ার, ২০২৪-এর ছাত্রগণহত্যার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। জামায়াত ফ্রগেরা ১৯৭১-এর গণহত্যার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। এগিয়ে গিয়ে প্রেসক্লাবে একসঙ্গে ঐকমত্যের পুরি খেতে চায়। স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার এরা সবসময়েই ছিলো। সুরের ধারার কলতলা বয়ানের কারণে লীগ-জামায়াত রাজনৈতিক অভিসারকে চেপে রেখে; বুবুকে বিশুদ্ধ সেকুলারিজমের আন্ধা পীর বানিয়ে রাখা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিদ্বেষের পালোয়ান আর ইসলামি চেতনার বিদ্বেষের পালোয়ানেরা হিন্দুত্ববাদের ও ইসলামি চেতনার পরস্পর বিরোধী জুজু দেখিয়ে ভয়ের রাজনীতি চালু রেখেছে অনন্তকাল ধরে।

বাংলাদেশ বাস্তবতায় এদের পাঁচ পয়সা দাম নাই। কৃষক ফসল ফলায়, শ্রমিক শ্রমের চাকা ঘুরায়; দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বেঁচে থাকে। আর এই দুটি ডাকাত দল ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে দেশলুন্ঠন করে। লুন্ঠনের ঘটনাগুলোকে ঢেকে রাখতে এরা কলতলায় সুরের ধারা ও সুরার ধারার পাতক-পাতকীদের অশ্লীল সব কোলাহল তৈরি করে রাখে। এদেরকে প্রত্যাখ্যান করলে দেখবেন; পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। যার মেধা আছে যোগ্যতা আছে পরিশ্রম করার অনুশীলন আছে; তারজন্য প্রতিটি দিনই ইতিবাচক। নেতিবাচকতা বসবাস করে দলান্ধের ইনসমনিক পদ্ম লোচনে।

মাসকাওয়াথ আহসান: রম্যলেখক, অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: