মাসকাওয়াথ আহসান:
৫ অগাস্টে বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের শিক্ষা হচ্ছে, দেশটা কারও বাপের না। গত ১৫ বছর ধরে আমরা সাধারণ মানুষেরা আওয়ামী লীগের নেতা ও সাইবার সৈনিকদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা কারো বাপের সম্পত্তি নয়। আওয়ামী লীগ ঘন বিজেপির সাইবার সৈনিকদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, তোমাকে কেউ বাঙালি সংস্কৃতির ঠিকাদারি দেয়নি।
বিএনপি ও জামায়াতের উচিত আওয়ামী লীগ ও বিজেপির পরিণতি দেখে শিক্ষা নেয়া। বিএনপিকে বুঝতে হবে দেশটা কারও বাপের না, জাতীয়তাবাদ কারও সম্পত্তি নয়। জামায়াতকে বুঝতে হবে, ইসলামি চেতনার ঠিকাদারি কেউ তাদের দেয়নি।
৫ অগাস্ট পরিবর্তনের পর প্রথম সুযোগে বিএনপি ও জামায়াতের লোকেরা দেশটাকে নিজের বাপের মনে করে স্কুল-কলেজের হেড মাস্টার ও প্রিন্সিপাল পোস্টটাকে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির যেসব লোকেরা নিজের বাপের পদ ভেবে দখল করেছিলো, তাদের কৌশলে সরিয়ে সেই পদগুলো দখল করেছে। স্বাস্থ্যবিভাগেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি ছিলো চাকরির ক্ষেত্রে দলীয়করণের বিপক্ষে, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের পক্ষে।
বিএনপি ও জামায়াত করা লোকেদের আইকিউ বা বুদ্ধাংক নেহাত কম না হলে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির লোকেদের পরিণতি দেখে শিক্ষা নেয়া উচিত ছিলো।
আওয়ামী লীগ ও বিজেপির শিক্ষক ও চিকিৎসকেরা তাদের কর্মক্ষেত্রটিকে দলীয় অফিসে পরিণত করেছিলো। তারা লোকজনের ওপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতি পুলিশি করে বেড়াতো। শিক্ষক ও চিকিৎসকের যে মূল কাজ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান; তা দেবার যোগ্যতা না থাকায়; চোটপাট আর লুটপাটই ছিলো তাদের একমাত্র কাজ।
৫ অগাস্টের পরিবর্তনের অন্তর্গত আওয়াজ যারা শুনতে পায়নি, সেই বিএনপি ও জামায়াতের জন্য অপেক্ষা করছে অশনি দিন।
বাংলাদেশের মানুষকে সহজ-সরল ও শান্তিপ্রিয় দেখে এদেরকে “বোকা” বলে জ্ঞান করেছিলো বৃটিশ তল্পিবাহক হিন্দু জমিদারেরা; হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার চরমসীমায় পৌঁছালে কৃষক প্রজারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন করে জমিদারদের পূর্ববঙ্গ থেকে পলায়নে বাধ্য করে।
পাকিস্তানের তল্পিবাহক মুসলিম জমিদারেরা একই রকম আন্ডার এস্টিমেট করেছিলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে। মুসলিম জমিদারদের অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে এদেশের সর্বস্তরের জনগণ আন্দোলন ও জনযুদ্ধ করে জমিদারদের বাংলাদেশ থেকে পলায়নে বাধ্য করে।
বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগ ৪৭-এর হিন্দু জমিদার উৎখাত আর জামায়াত সমর্থিত বিএনপি ৭১-এর মুসলিম জমিদার উৎখাত দেখে শিক্ষা নেয়নি। তারা বুঝতে পারেনি এদেশের মানুষের মূল সমস্যা তারা “বাপের জমিদারি প্রথা” সহ্য করতে পারে না। বাংলাদেশ সমাজের মূল প্রত্যাশা বৈষম্যমুক্ত সাম্য চিন্তার সমাজ। কারও গাজোয়ারি মনোভাব তারা বেশিদিন নিতে পারে না।
স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের ক্ষীণবুদ্ধির লোকেরা তবু বারবার বাপের জমিদারি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে; জনগণ তাদের প্রতিহত করেছে। বিএনপির ক্ষীণবুদ্ধির লোকেরা বাপের জমিদারি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
আর ৪৭-এর পরাজিত শক্তি কট্টর হিন্দুত্ববাদ বার বার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে। ৭১-এর পরাজিত শক্তি কট্টর ইসলামপন্থা বার বার চেষ্টা করেছে তাদের মনগড়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে।
বাংলাদেশের হাজার বছরের যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সেখানে কট্টর হিন্দুত্ববাদ বা কট্টর ইসলামপন্থার জায়গা কখনই ছিল না। প্রতিটি ধর্মই এখানে মাটি ও মানুষের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে কোমল চেহারায় জনপ্রিয় হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি মামাদের প্রধান ভুল হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া আর জামায়াতের ধর্ম মামাদের প্রধান ভুল হচ্ছে হিন্দু ফোবিয়া। এই দেশ এই জনপদ কোন ফোবিয়াকে প্রশ্রয় দেয় না। আর নিম্ন বুদ্ধাংকের আওয়ামী সংস্কৃতিমামা ও নিম্ন বুদ্ধাংকের জামায়াতি ধর্ম মামা কী করে এতো কম জানাশোনা নিয়ে বাংলাদেশের তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন জনমানুষকে মনগড়া সংস্কৃতি ও ধর্ম বোঝাতে আসে!
এই দেশের প্রত্যন্তের চায়ের দোকানগুলোও এরিস্টোটলের পাঠশালার মতো। কৃষক-শ্রমিক-কারিগরের যে রাজনীতি ও সংস্কৃতি সচেতনতা তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত সংস্কৃতি বেত্তা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাঝে অনুপস্থিত।
মনে রাখতে হবে জুলাই বিপ্লবে প্রথম ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ। ১৫ বছর চেষ্টা করে বিএনপি ও জামায়াত বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু জুলাই বিপ্লবে রাস্তার ফেরিওয়ালারাও এসে বিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের ফলমূল-সিঙ্গাড়া পরিবেশন করেছে, রিকশা চালকেরা রিকশা মিছিল করেছে।
২০২৪-এর মা মিছিলে তার সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিয়েছে। এই জননী সাহসিকার দেশ বাংলাদেশ। জুলাই বিপ্লবে হিজাব ও ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরা ছাত্রীরা হাতে হাত রেখে বর্তমান ও আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
কাজেই ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের “দেশটাকে বাপের দেশ” মনে করা রাজনীতিকদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠেছে দিকে দিকে। দেশ ডাকাতি করতে রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে “লালসালুর মাজারে” পীরের পরিবারের লোককে গদিনশীন করে গণতন্ত্রের আলাপ; অথবা ধর্ম পুলিশি করে হিন্দুত্ববাদ ও ইসলামপন্থার প্রাধান্য বিস্তারের সময় ফুরিয়েছে।
বিএনপি ও জামায়াতকে তাই তাদের চিন্তার অচলায়তন থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতি পুনর্ভাবনা করতে হবে। বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগের অনুতাপহীন নরখাদকদের বিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের ছিদ্রান্বেষণ বাদ দিয়ে, নিজেদের চরিত্রের শতছিদ্র ঝাঁঝরার দিকে মনোযোগী হতে হবে।
সরকার পরিবর্তনের পর যেসব দুধের মাছিরা স্বজনপ্রীতি ও তেলাঞ্জলির মাধ্যমে অথবা বিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের মাথায় হাত বুলিয়ে পদ বাগাতে চেষ্টা করছেন, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। বুড়ো ভাম হয়ে গেছেন তবু একটা ন’টা-পাঁচটা চাকরির জন্য লোলুপ নয়নে তাকিয়ে আছেন! কী পড়ালেখা করেছেন; কী যোগ্যতা তাদের যে পকেটে সিভি নিয়ে উপদেষ্টাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়!
মাসকাওয়াথ আহসান: রম্য লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট