বিবাহ, নারীহত্যা ও ডিভোর্স

সাবরিনা শারমিন চৌধুরী:

বিবাহ পর্ব:

বিবাহ কোনও সম্পর্ক নয়। বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি। মানব সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ‘পরিবার’ প্রতিষ্ঠা এ চুক্তির মূল লক্ষ্য। আমাদের দেশে এটি একটি অসম চুক্তি, যেখানে চুক্তির বিধান মেনে দুই পক্ষের সমান অধিকার সংরক্ষিত হয়নি। যাইহোক, এই অসম চুক্তির শর্তগুলো ঠিকঠাক মেনে চলতে পারলে এটি হয় একটি দীর্ঘস্থায়ী সহাবস্থান, নয়তো স্বল্পকালীন যুগল জীবন। শর্ত মেনে চলে চুক্তি বহাল রাখার পরিস্থিতি যদি কখনো না থাকে, তবে সে চুক্তির শর্ত অনুসারেই এই চুক্তি বাতিল করার যৌক্তিক সক্ষমতা নারীদেরকে অর্জন করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থানের চেয়েও নারীর মানসিক অবস্থান এখানে দুর্বল। একটি সামাজিক চুক্তিকে ‘আমৃত্যু (ভালবাসার) সম্পর্ক’ বিবেচনা করে নারী এর প্রতি ভীষণভাবে দুর্বল থাকে এবং যেকোনো উপায়ে এ সম্পর্কটিতে ঝুলে থাকে। স্বামী জ্ঞানে চুক্তির অপর পার্টনারকে ক্রমাগত পেছন থেকে টানতে থাকে, আটকাতে থাকে। না সে নিজেকে মুক্ত করতে জানে, না পার্টনারকে মুক্তি দিতে জানে। ফলশ্রুতিতে, হত্যা। নিজের দুর্বলতা তাকে একদিন সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়। খুন হয়ে যায় নারী।

ভালবাসা একটি সম্পর্ক। বিবাহ একটি চুক্তি। বিবাহ চুক্তিতে সাক্ষর করা মানেই আপনি ভালবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন এমনটা নয়। এ সত্যটা মেনে নেওয়ার মতো যুক্তিযুক্ত একটা মন এদেশের মেয়েদের তৈরি করতে হবে। একটি চুক্তি বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের প্রাণ ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। চুক্তি বাঁচিয়ে রাখার দায় দু’পক্ষের।

ডিভোর্স পর্ব:

দেশে ডিভোর্স বেড়ে গেছে এবং নারীরাই ডিভোর্সের দিকে বেশি ঝুঁকছেন, ইদানিং এমনটিই খুব বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে। কেউ কেউ আবার একটু এগিয়ে গিয়ে ডিভোর্স বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও তাঁর স্বনির্ভরণকে দুষছেন। আমাদের সমাজে ’নারী’ ভীষণ চর্চিত এক বিষয়। নারী কী পরলো, কীভাবে হাঁটলো, কার সাথে খেলো, কোথায় ঘুমালো, কাকে বিয়ে করলো, কাকে ছেড়ে গেল ইত্যাদি সবকিছু আতসী কাঁচ দিয়ে দেখে তার একান্ত জীবন নিয়ে চর্চায় মেতে ওঠে সমাজ। ডিভোর্স বা পুনরায় বিবাহের মতো ঘটনা হলে তো কথাই নেই। যতক্ষণ না মেয়েটির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ছে, মাথা নত হতে হতে মাটিতে নেমে না যাচ্ছে ততক্ষণ ছাড়াছাড়ি নেই। ডিভোর্সের দায়ও তাই নারীর মাথায় চাপিয়ে তাকে সামাজিকভাবে অবদমিত করার এক অসভ্য কৌশল মাত্র।

কেন বেড়েছে ডিভোর্স? হালে নারীই বা কেন ডিভোর্সের দিকে বেশি ঝুঁকছেন? আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কী, নারী কচ্ছপের মতো চলতে চলতেই আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। শিক্ষায়, মেধায়, মননশীলতায়, কর্ম দক্ষতায়, নেতৃত্বে ও দায়িত্বশীলতায় নারী নিজেকে প্রমাণ করে দিয়েছে। আবার সেটি করতে গিয়ে নারী তার জন্য পূর্ব নির্ধারিত দায়িত্বে ইস্তফা দিয়েছে এমনটিও ঘটেনি। যেমন নারী ঠিকই পরিবারের জন্য ভালোবেসে রান্না করে চলেছে, সন্তান লালন, বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবা, ভাইয়ের পাঞ্জাবিতে ফুল তোলা, স্বামীর দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাগালেই রাখা, শাশুড়ির মশারী টাঙিয়ে দেওয়া – না, এগুলোতেও বিঘ্ন ঘটে নি। তাহলে? গোলমালটা কোথায় হলো?

গত ৫০ বছরে পুরুষ এগোয়নি একচুলও। যেহেতু সে এগিয়েই ছিল, তাই খরগোশের মতো দম্ভ নিয়ে গরগর করে ঘুমিয়েছে, আর মাঝেমধ্যে চোখ পিটপিট করে অতি ধীরে এগোতে থাকা নারীদের নামে পিন্ডি চটকিয়েছে। একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখলো নারী তার স্পর্শসীমানা ছাড়িয়ে গেছে। তারপর? তারপর পুরুষের মধ্যে যা ঘটতে লাগলো –

১. দেখেশুনে নিজের চেয়েও বেশি শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করা। তারপর, বিদ্যার অহংকার দেখাস?
২. জেনেবুঝে চাকুরিজীবী মেয়েকে বিয়ে করা। তারপর, টাকার গরম দেখাস?
৩. বেছে বেছে স্মার্ট ক্ষুরধার মেয়ে বিয়ে করা। তারপর, রূপের দেমাগ দেখাস?

এরপর নারীর ওপর পরিবর্তনের কঠোর কঠিন চাপ শুরু হয়। অথচ পরিবর্তন প্রয়োজন পুরুষের, নিজেকে যুগোপযোগী সংশোধন করে আপগ্রেড হওয়া দরকার। কিন্তু সে তো পুরুষ, নিজের পরিবর্তন মানে নত হওয়া। তা সে হবে না। নত হতে হবে নারীকেই, এগিয়েই আছে, তবুও পরিবর্তন হতে হবে নারীকেই। যে মেনে নিল, সে হলো আনুগত্যের শিকল পরা সুশীল নারী। আর যে মানতে পারলো না এই অন্যায় আবদার – নৈমিত্তিক কলহ-বিবাদ, অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়ে সবশেষে তাকে যেতে হলো মুক্তির পথে, বিবাহ বিচ্ছেদের পথে।

এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া সাহসী নারীদেরকে বলি হতাশ না হতে। অন্য কেউ চাইছে বলেই যেন কখনও নিজেকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে দেবেন না। চড়াই উৎরাইয়ের জীবনে হোঁচট খেয়ে, আঘাত পেয়ে নিজেকে কখনো লুটিয়ে পড়তে দেবেন না। জীবনে যা কিছুই ঘটুক, নিজের কাছে নিজের দেওয়া প্রধান বার্তাটি হোক – “মেরুদণ্ড থাকতে হবে সোজা, মাথা রাখতে হবে উঁচু”।

জীবনে হলো না হয় একটু ছন্দপতন। ভয় কী তাতে! ছন্দ পতনের গল্পের সাথে জুড়ে থাকে উঠে দাঁড়াবার শক্তি। প্রথা ভাঙ্গা সহজ নয়, তবুও বাধ্য হয়ে ভাঙতেই হয় কাউকে না কাউকে। নারীশক্তিই ভাঙ্গুক সে প্রথা। হোক না ডিভোর্স আরও বেশি, নারীই করুক বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন। তবুও বোধদয় হোক সমাজ-সংসারের, অসমতার অচলায়তন ভেঙ্গে মুক্তি হোক মানুষের – নারী ও পুরুষের।

শেয়ার করুন: