নারী, তুমি এবার একটু জিরোও

তামান্না তাবাসসুম:

কোন নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার এমন ঘটনা শুনলেই সাথে সাথে আমরা ওই নারীকে বলি স্বাবলম্বী হতে। এই কথাটার মাধ্যমে যে ক্রিমিনাল ফোকাসটা তার দিক থেকে অন্য দিকে সরে যায়। আর মিনিংটা এমন হয়ে যায়যে, যে ইনকাম করে না তাকে নির্যাতন করাই যায়! সেই মুহূর্তে আসলে আমাদের যে অন্যায়কারী তার সাজা নিয়েই কথা বলা উচিৎ। স্বাবলম্বীতার প্রসঙ্গ আসবে পরে।

বিয়ে হলে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি থেকে লেখাপড়া করতে দেয় না তাই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করতে উৎসাহিত করা হলো। তারপর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে চাকরি করতে দেয় না দেখে আগে ক্যারিয়ার গড়ে তারপর বিয়ে করতে উৎসাহিত করা হলো। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যে কোন মেয়ে পড়বে কি পড়বে না, চাকরি করবে কি করবে না সহ তার অন্যান্য ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না এই নিয়ে কেউ কিছু বললো না।

যখন অনেক বছর সংসার করার পরেও ঝগড়ার সময় স্বামী ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বললো, ভাইয়েরা সম্পত্তির ভাগ দিলো না ; নারী তখন আবেগী হয়ে বললো – নারীর নিজের কোন বাড়ি নাই, যেদিন সে নিজের টাকায় বাড়ি বানাতে পারবে সেটাই হবে তার আসল বাড়ি। অথচ আইনত, ধর্মমত সে নিজের প্র‍্যপ্য অধিকারটা আদায়ের জন্য লড়ার কথা চিন্তা করলো না। নিজের কাঁধেই ভার নিয়ে নিল। বাড়ি সে করতেই পারে, তাই বলে স্বামীর বা বাবার থেকে প্র‍্যাপ্যটার অধিকার ছাড়বে কেন!

ঘরের সব কাজ একা নারীর কাঁধে, এমন সময় যখন তার চাকরি হল সে বললো, আমি পুরো সংসার সামলিয়েই চাকরি করবো। তারপর কাজের সাথে সংসার খরচেরও ভাগ নিলো। ফেরার পথে বাজারটাও করা শুরু করলো। যেহেতু শিক্ষিত মা, তাই সন্তান পড়ানোর দায়িত্বও তার একার কাঁধেই নিতে হলো।
এভাবে কোন বোঝা কমার বদলে দিন দিন শুধু বাড়ছে তো বাড়ছেই। দেখেন না আগে ফর্সা হওয়ার ক্রিমের এডগুলোতে শুধু সুন্দরীর জয় দেখাতো, আর এখন সুন্দরী তো হতেই হবে মাস্ট, তার সাথে লাগবে সফলতার গ্লো!

ভিমবারের এডে এখন দেখায়, শুধু ভালো হাঁড়িপাতিল মাজতে পারলেই চলবে না, ভালো হাঁড়িপাতিল তো মাজতে পারতেই হবে মাস্ট, সাথে সাথে ক্যারাতে বা অন্য স্কিলও থাকতে হবে।
ওহ্, এদিকে নারীর আত্মসম্মানবোধ কিন্তু আবার দারুন টনটনা, পান থেকে চুন খসলেই তার মান সম্মান যায়।
সারাদিন সংসারের জন্য খেটে বরের থেকে হাত খরচটা নিলেও তার নাকি প্রেস্টিজ চলে যায়! এদিকে বর বেচারার বউয়ের থেকে সংসারের এতো এতো ফেভার নিলে প্রেস্টিজ যায় না!
বিয়েতে দেনমোহর নিলেও নাকি সম্মান যায়! নিতে হবে ১ টাকা, নাইলে বই!
নারীরে উন্নয়ন করতে করতে একদম দেবীর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সে নাকি একাই একশ। তার কারো কোন সাহায্যের প্রয়োজন নাই!
এভাবে একা সব সামলে দিনের পর দিন রেস্ট না নিয়ে, ঘুমাতে না পেরে নারী যখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, মলিন; তখন বলা হয় তুমি নিজেকে ভালবাসো না, নিজেকে সুন্দর আর ফিট রাখতে পারো না। চাইলে এর মধ্যেই নিজেকে সুন্দর রাখা যায়।

চাইলেই সব পারে ঈশ্বর। মানুষ না। আবার কেউ সব করছে মানেই যে সে সব পারে এমনটাও না। বাইরে থেকে অনেক কিছুই ঝা চকচকে লাগে, ভেতরে অন্য গল্প থাকে।
আগে তো কালো মানুষদের দাস বানিয়ে কত অমানিবিক কঠিন পরিশ্রম করানো হতো। ৩/৪ বছরের ব্ল্যাক বাচ্চাদের দিয়ে গরম চিমনির ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হতো পরিষ্কার করানোর জন্য। তাহলে আমরা কি এখন বলবো যে ৩/৪ বছরের বাচ্চা গরম চিমনি পরিষ্কার করতে পারে, এটাই স্বাভাবিক? যারা পারে না তারা পারফেক্ট না?

নারী ভেবেছে সে একা বদল হয়ে দুনিয়ে বদলে দেবে। আসলে এক হাতে যে তালি বাজেনা তার একটা বড় প্রমান এটা। নারীর বদলের জন্য যত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, পুরুষের বা সমাজের মনমানুষিকতা বদলের জন্য করা হয়নি তার কিছুই। এই পশ্চাদপদ সমাজে নারীর একা একা উন্নত হয়ে খেটে মরে লাভটা হবে কি?

নারী নিজের কাঁধে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে নিতে নুয়ে পড়ছে, আর পুরুষ মুক্ত হতে হতে হয়ে যাচ্ছে পালকের মত। ঘরের তেমন কোন দায়িত্ব না থাকায় আবার এদিকে খরচেরও কিছু দায় নারী নিয়ে নেয়ায় তারা হয়ে যাচ্ছে গেইম আসক্ত, পর্ণ আসক্ত।

এখানে বেগম রোকেয়ার সেই একটা গাড়ীর দুই শকটের উদাহরণটা এখন উলটো হয়ে গেছে। এখন নারী হয়েছে বড় চাকাটা আর পুরুষ হয়েছে ছোটটা।
এমন কত পরিবার দেখেছি যেখানে নারী সংসার সামলায়, রান্না করে, জব করে, বাজার করে, বাচ্চা পড়ায়, সংসারের অর্ধেক খরচ দেয়। আর পুরা সংসারে পুরুষের কন্ট্রিবিউশন শুধু হাফ খরচ দেয়া! এভাবে খুব সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আপনাদের!

আগে দেখতাম প্রতি সন্ধ্যায় বাবারা বাচ্চাদের পড়াতে বসতো। সেই কালচারটাই এখন নাই। এখন বাচ্চা পড়ানো মানেই যেন মায়ের একার দায়িত্ব। আগে বাড়ির কিশোর ছেলেরা বাজার করতো, বিল দিতো। আর এখন বয়স্ক ক্লান্ত মা বাজারে ছোটে, বিল দেয় আর কিশোর ছেলে গেইম নিয়ে ব্যস্ত।

একপাক্ষিক নারীর কাঁধে সব দায়িত্ব হওয়ায় নারীর প্রতি সমাজের এক্সপেক্টেশন এতো এতো বেড়ে গেছে, ফলে নারী পাচ্ছে একটা ক্লান্ত অসুখী জীবন। যে হাউজওয়াইফ তার মনে হচ্ছে আমি জব করিনা, যে জব করে তার মনে হচ্ছে আমি সংসারের কাজ গুছিয়ে করতে পারছি না, আবার যে দুই দিকেই সময় দিচ্ছে তার হয়তো বাচ্চা আর পার্টনারের দিকে তাকানোর ফুসরত হচ্ছে না। সব পারার আর পারফেক্টশনিস্ট হওয়ার একটা মরীচিকার পিছনে ছুটেতে ছুটতে ক্লান্ত নারীজীবন।

মেয়ে তুমি এবার একটু জিরাও। নাও দ্যা ওয়ার্ল্ড উইল এডজাস্ট।

শেয়ার করুন: