অস্তিত্বের সংকট

রুমানা সোবহান পরাগ:

আসছে নভেম্বরে মৌলির শ্বশুর-শাশুড়ির ৫০ তম বিবাহবার্ষিকী। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে তার মনে তুমুল উত্তেজনা কাজ করছে। সে চাইছে এ বিষয়ে তার মতো সবাই উদগ্রীব হোক। অথচ সবার আচরণে কেমন যেন একটা উদাসীনতা। বিশেষ করে তার শাশুড়ি হোসনেআরা বেগম যিনি শুধু উসিলা খোঁজেন আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর জন্য, সেই তিনিও কিনা বিবাহ বার্ষিকী আয়োজনের কথা শুনতেই পারছেন না।

গত সপ্তাহে মৌলির বড় জা দোলা বিকেলে চা খাওয়ার সময় ওদের শাশুড়িকে বলেছিল,

– মা, ৫০ বছর একসাথে পাড়ি দিলেন আপনারা। কেমন ছিল এই জার্নি?

– হ‍্যাঁ বৌমা, অনেক লম্বা একটা সময় জীবন থেকে হারিয়ে গেল। এখন আমার বয়স ৬৬ আর তোমাদের বাবার বয়স ৭৮। ম‍্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার পর সরকারি চাকরিরত এক ছেলের সাথে ঘটা করেই আমার বিয়ে দিল বাবা। এজন্য বাবাকে বেশ ধারকর্য করতে হয়েছিল। কিন্তু ওদের ছিল আকণ্ঠ নিমজ্জিত লোভ, যদিও ওরা আমার বাবার আর্থিক অবস্থা কেমন তা জেনেই আমাকে বৌ করে এনেছিল।

– থাক মা, সব কথাতেই আপনি পুরোনো ইতিহাস কেন টেনে আনেন! কষ্টের কথা তুলে লাভ কী বলেন তো। যে স্মৃতি মনকে বিষিয়ে তোলে সেই কথা মনে না করাই ভালো।

– আরে, আমি তুলেছি কই? তুমিই তো জানতে চাইলে।

– বাবা আপনাকে ভালোবেসে ফ্লাট লিখে দিয়েছেন, এ কথা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই মা।
– হ‍্যাঁ, তিন পা কবরে রেখে এখন আমি ফ্লাটের মালিক হয়ে কী করবো?

– কাজের কথায় আসি মা। আপনার নাতি-নাতনিরা চাচ্ছে আপনাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে একটা গ্রান্ড সেলিব্রেশন করতে। ওরা বলছিল ইভেন্ট ম‍্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব দিলেই হবে। এতে আমাদের কোনো ঝামেলাই পোহাতে হবে না।

এ কথা শুনে হঠাৎ হোসনেআরা বেগম রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের কি কাঁচা টাকা হয়েছে যে বাইরের লোকের মাধ্যমে নিজেদের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে? এরা পুরো বাড়িটাকে একটা শুটিং স্পট বানিয়ে ফেলবে। রেবেকার মেয়ের বিয়েতে গিয়ে দেখলাম কী বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে আসছে আবার কাপড় চোপড় আনছে। বলে, ওদের দেয়া কাপড় পরে যেতে হবে। বিয়ের দাওয়াতের নামে বাড়ি বয়ে এসে জুতা মেরে গেল। বিয়েতে পরার মতো কি আমাদের নিজেদের কাপড় জামা নেই? নাকি আমাদের গেঁয়ো ভূত মনে করে? তারপরও ওদের সম্মান রক্ষায় তো গেলাম। গিয়ে দেখি একি এলাহি কারবার! রীতিমতো সিনেমার শুটিং চলছে মনে হচ্ছে। সবই লোক দেখানো। কোথাও কোনো স্বাভাবিকতার লেশমাত্র নেই।

– মা, এগুলোই এখন চলছে। গরীব ধনী সবাই-ই চেষ্টা করে অনুষ্ঠানের আয়োজনে নতুনত্ব আনতে।

– দেখো বৌমারা, সবাই করে করুক, আমি করবো না। জীবন থেকে ৫০ টা বছর হারিয়েছি সেটার জন্য তো শোক দিবস পালন করা উচিৎ আমার।

বড় বৌ দোলা বেশ বুদ্ধিমতী, সে আর কথা বাড়তে না দিয়ে চায়ে চিনি বেশি হয়েছে বলে বুয়াকে ডেকে বেশ করে বকে মাগরিবের নামাজ পড়ার কথা বলে নিজের ঘরে চলে গেল। মৌলি হতভম্ব হয়ে গেল শাশুড়ির এহেন আচরণে। সেও বেরিয়ে যাচ্ছিল।

এমন সময় হোসনেআরা বেগম ‘ছোট বৌমা’ বলে ডেকে ওঠেন। বললেন, বসো। সোফায় হেলান দিয়ে বসে ডান হাতটা কপালের উপর রেখে বললেন,

‘দেখতে দেখতে প্রায় ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবন একসাথে পার করেছি। কী ভয়ানক এক লড়াই-ই না আমি করেছি বৌমা, শুধু টিকে থাকার জন্য। তোমাদের শ্বশুর কোনদিন গায়ে হাত তোলেনি, তবে কথায় মার দিয়েছে। বাপের বাড়ি থেকে ওদের চাহিদামতো জিনিস আনতে পারিনি বলে কোনো বেলার ভাত আমাকে শান্তিতে খেতে দেয়নি। প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা, অবহেলা, বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার ভয় দেখানো, কোনটাই বাদ রাখেনি। সবসময় অস্তিত্বের সংকটে ভুগতাম আমি।

নেহায়েত গরীব ঘরের মেয়ে ছিলাম বলে মাটি কামড়ে পড়েছিলাম এই সংসারে। আর আত্মবিশ্বাসেরও অভাব ছিল প্রকট। তাই জীবনে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করিনি। আজকে ৫০ বছরের কোঠায় এসে মনে হচ্ছে কীভাবে এতো অনাচার আমি মুখ বুঁজে সহ‍্য করেছি! যেখানে জীবনেরই কোনো নিশ্চায়তা নেই সেখানে সংসার পারমানেন্টলি টিকে থাকার জন্য কতো অপমান আমি সয়েছি। মানসিকভাবে এতোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম যে মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করার কথা যে ভাবিনি, তা কিন্তু নয়। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধর্ম আর চারটা নিষ্পাপ সন্তানের মুখ।

প্রতিবেশি কোনো মহিলা বা ছোটবেলার কোনো বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ রাখার অনুমতি ছিল না। মানুষের সামনে ওরা আমাকে ও আমার পরিবারকে ছোট করার জন্য যা-তা বলতো।

একটা টাকা কোনদিন হাতে দিয়ে বলেনি, ভাইবোনের জন্য খরচ করো। শাড়ি কাপড় দিয়েছে, কিন্তু কোনদিন আমাকে পছন্দ করে কেনার অনুমতি দেয়নি। আমি শ্রমিকের মতো কামলা দিয়েছি, অথচ আমার মর্যাদা ছিল ভিখারীর মতো। এ সংসারে কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম ছিল। প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা, আর এমন এমন মানুষকে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় হিসেবে পেয়েছিলাম যাদের সঙ্গে কোনো রকম উষ্ণ, স্থায়ী আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমার।

বিয়ের সময় ওরা কথা দিয়েছিল আমাকে পড়ালেখা করার সুযোগ দেবে। অথচ পরপর চারটা বাচ্চার মা বানিয়ে ঘরের বাইরের আলো দেখারই সুযোগ দেয়নি। আমরা একসাথে থেকেছি, কিন্তু কোনো মান অভিমানের পর্ব ছিল না আমাদের মাঝে। হুকুম তামিলের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত করেছি বিবাহিত জীবনের এতোগুলো বছর। তোমার শ্বশুর ভালো করেই জানতো আমার যাবার কোনো জায়গা নেই, তাই সে নির্ভয়ে এতো অসম্মান করতো। শুধু সন্তানদের অস্তিত্বের কথা ভেবে সবকিছু মুখ বুঁজে সহ্য করেছি।

এসব নির্যাতন তাও সহ‍্য করা যায়, কিন্তু অন্য নারীতে আসক্তি তা মেনে নেব কীভাবে? কিন্তু তাও নিয়েছি। বাড়ির বাইরে একের পর এক পরকীয়া আর এদিকে কাজের বুয়া, বাচ্চাদের মাস্টারনি কেউ বাদ যায়নি তার ছোকছোকানি থেকে। কখনও কখনও ওরাও এই সুযোগটা নিত। তখন আমাকে কাজের বুয়া বা মাস্টারনীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। কূটকৌশল করে ওদের তাড়াতে হয়েছে। একটা পাকাপোক্ত অবস্থানের জন্য কতো নিচেই না আমাকে নামতে হয়েছিল। অথচ সবসময় একটা সুখী পরিপাটি নকল জীবনের দৃশ্য আমি দৃশ‍্যায়ন করেছি।

– মা, বাদ দিন না এসব কথা। বাবা এখন অসুস্থ। এরকম অসুস্থ মানুষের উপর রাগ পুষে রাখতে নেই। আর এসব কথা বলে ওনার প্রতি সবার অশ্রদ্ধা তৈরি করাও পাপ।

– আমি জানি ওর প্রতি আমার উদাসীন আচরণে তোমরা রুষ্ট হও, কিন্তু একবার আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখো তো ক্ষমা করতে পারবে কিনা তাকে যার কথায় সারারাত চোখের পানিতে তোমার বালিশ ভেজে! যে আমার জীবনের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়েছিল তার দেয়া এই সম্পত্তি আমার কাছে অতি তুচ্ছ মা। পৃথিবীর সব প্রাণীই আদরের কাঙাল; আমি এর ব‍্যতিক্রম ছিলাম না। না খেয়ে দিন পাড়ি দেয়া যায়, কিন্তু অপমানের ভাত গেলা যায় না মা।

ওর ওপর আমার রাগ নেই ; নিজের বোকামির জন্য নিজের উপরই রাগ হচ্ছে আমার। এখন আমার বয়স ৬৬, ভাগ্যে যদি থাকে আরও জোর বেশি ১০-১২ বছর হয়তো আমি টিকে থাকবো। তাহলে আমার এই জীবনে আমি কার জীবন যাপন করলাম ! আমি তো একদিনের জন‍্যও নিজের মতো করে বাঁচিনি। আমি বলতে পারি না আমার প্রিয় পোশাক কী, প্রিয় খাবার কী? আমার শখের মৃত্যু হয়েছিল সেইদিনই যেদিন আমার বিয়ে হয়েছিল। মৃত্যুই যদি জীবনের একমাত্র সত‍্য হয়, তাহলে এক জায়গায় টিকে থাকার জন্য এতো কষ্ট আমি কেন করেছি? প্রতিটা দিন আমি ভয়ে আর শঙ্কায় কাটিয়েছি এই বুঝি আমার সংসার চলে গেল। সর্বক্ষণ একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে থেকেছি।

কেন সাহস করে বেরিয়ে আসিনি এই বন্দিশালা থেকে? এই সংসারে টিকে থাকার জন্য যে শ্রম, প্রজ্ঞা আর ধৈর্য্য আমি ধরেছিলাম তা যদি নিজের একটা পরিচয় তৈরিতে ব‍্যয় করতাম তাহলে হয়তো আজকে বাংলাদেশের সেরা দশজন সফল নারীর মধ‍্যে আমার নামটাও থাকতো। আমি ভুল জায়গায় আমার সময়, শ্রম আর মেধার অপচয় করেছিলাম। এখন তো আমার আর নতুন করে কিছু করার বা পাওয়ার নেই, বৌমা। জীবনের প্রতি কোনো আকর্ষণও নেই।

আর তোমরা আসছো এই অর্ধশতক বছরের লোক দেখানো প্রেমময় দাম্পত‍্য জীবনের নাটক মঞ্চস্থ করার পয়গাম নিয়ে! তোমরা তোমাদের বড়লোক শ্বশুরকে মাথায় নিয়ে নাচো, তাতে আমার কোনো অসুবিধা নাই। তবে আমাকে দিয়ে আর কোনো নাটক সিনেমা করিও না বৌমা, আমি ভীষণ ক্লান্ত।

– মা অল্প চিনি দিয়ে আরেক কাপ চা করে আনি, বলে শাশুড়ির ঘর থেকে সেদিন মৌলিও বেরিয়ে গিয়েছিল।

শেয়ার করুন: