যে কারণে ঘুম একটি জেন্ডার ইস্যু

নাহিদা নিশি:

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এর একটি উক্তি আমরা খুব ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, “তাড়াতাড়ি ঘুমানো এবং তাড়াতাড়ি ওঠার অভ্যেস একজন মানুষকে সুস্থ, ধনী এবং জ্ঞানী করে তোলে”। ঘুম ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ানো থেকে মেমরি গঠন পর্যন্ত, সবকিছুতে সাহায্য করে। শরীরের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি শারীরিক প্রক্রিয়াই ঘুম দ্বারা প্রভাবিত হয়। কোন কোন চিকিৎসকের মতে, একটি দীর্ঘ ও পরিপূর্ণ ঘুমই পারে আমাদের অর্ধেকের বেশি শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা দূর করে দিতে, অথচ মোট জনসংখ্যার একটি প্রধান অংশ, নারীরা প্রায় সারাজীবন ধরে পরিপূর্ণ ঘুমের অভাবে ভুগে থাকেন।

পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি ভয়াবহ জেন্ডার গ্যাপ পরিলক্ষিত হয়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলেও তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে না পারায় নারীর পক্ষে সুস্থ, ধনী এবং জ্ঞানী হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে দৈনিক কমপক্ষে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেয়, অথচ মাত্র ১২% নারী এটি নিশ্চিত করতে পারে। এদিকে নিউরোসায়েন্স বলছে, পুরুষের চেয়ে নারীদের দৈনিক অন্তত ২০ মিনিট বেশি ঘুমানো প্রয়োজন। বেশি তো দূরের কথা, বিশ্বব্যাপী নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রচুর পরিমাণে নিদ্রাহীনতায় ভুগছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন অনুযায়ী, অনিদ্রায় ভোগা নারীর পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ।

২০১৯ সালের যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রতি রাতে গড়ে ৩ ঘন্টা কম ঘুমান, এক বছরে প্রায় ১০৯৫ ঘন্টা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় অর্ধেকের বেশি ব্রিটিশ নারী ক্রমাগত পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার অন্য একটি গবেষণা মতে, প্রায় ৬১ শতাংশ নারী নিয়মিত অনিদ্রাজনিত সমস্যার সাথে যুদধ করেন, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৩৯ শতাংশ। ব্রিটিশ সাইকোথেরাপিস্ট এবং যোগব্যায়াম বিশেষজ্ঞ লিসা বলেন “নারী এবং পুরুষের মধ্যে যেমন বেতনের ব্যবধান রয়েছে, তেমনি ঘুমেরও ব্যবধান রয়েছে এবং এটি অবশ্যই লিঙ্গভিত্তিক”।

নারীর এই স্লিপ ডিপ্রাইভেশনের পেছনে শারীরিক এবং মানসিক অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বয়ঃসন্ধির আগ পর্যন্ত নারী-পুরুষের মধ্যকার ঘুমজনিত কোন ভিন্নতা সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না। বয়ঃসন্ধির পর থেকে মেন্সট্রুয়েশনের সময়টাতে মেয়েরা শারীরিক কারণেই পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে। এটাকে বলা হচ্ছে পিরিয়ডসমনিয়া। হরমোনের ওঠানামা, মুডসুয়িং, শরীরের তাপমাত্রা বৃদধি, লিকেজ, প্যাড পরিবর্তন, পেটব্যথাসহ বিভিন্ন সমস্যা নারীর এই পিরিয়ডসমনিয়ার জন্য দায়ী। দেখা যাচ্ছে, ৩০% নারী পিরিয়ডকালীন ঘুমজনিত সমস্যায় ভোগেন শুধুমাত্র ওভারলিকেজের কারণে। বলা হচ্ছে, পিরিয়ড একজন নারীর জীবন থেকে গড়ে ৫ মাসের ঘুম কেড়ে নেয়।

গর্ভাবস্থায় নারীর অনিদ্রার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। অন্যান্য শারীরিক- মানসিক সমস্যা বাদেও পেটের আকার বেড়ে যাওয়ায় এসময় ঘুমের সমস্যা বাড়তে থাকে। এই নিদ্রাহীনতা বেশিরভাগ সময় নারীর প্রসবোত্তর ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণা বলছে, গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে সন্তানের বয়স ৬ হওয়া অব্দি একজন মায়ের গড়ে প্রতিরাতে ১ ঘন্টা করে ঘুম নষ্ট হয়। বাচ্চাকে খাওয়ানো, ন্যাপি চেঞ্জ করা, ঘুম পাড়ানো সবটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাকে একাই করতে হয়। যদিও আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমানভাবে প্যারেন্টিং করার কথা ছিল, তারপরও কোন কোন বাবাকে আলাদা ঘরে ঘুমাতে দেখা যায়, বাচ্চার কান্নায় অসুবিধা হয় বলে।

এই সমস্ত শারীরিক- মানসিক কারণ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী যে লিঙ্গভিত্তিক কারণটি নারীর অনিদ্রার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী, তা হলো ঘরের কাজের অসম বণ্টন। গবেষণা অনুযায়ী, ঘরের কাজে একজন পুরুষ দৈনিক গড়ে ৩৬ মিনিট ব্যয় করেন, যেখানে একজন নারী ব্যয় করেন ২৮০ মিনিট! ভাবা যায়! একারণেই বোধ হয় জাতিসংঘের নারী অধিকার বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএন উইমেন’ বলছে- বর্তমানে নারী অগ্রগতির যে হার, তা অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাপী নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করতে কমপক্ষে আরো ৩০০ বছর লাগবে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতা “যদি কোনদিন” এ লিখেছেন- “২৬ বছরে ১বারো দেখিনি মা কখন ঘুমাতে যায়, ঘুম থেকে কখনই বা উঠে, তার কোন উৎসব নেই, পা ছড়িয়ে বিকেলের গল্পগাছা নেই”। এই কবিতা পড়ে প্রথমবারের মতো মায়ের ঘুমহীন চোখের দিকে লক্ষ্য করলাম, ঘুমকে একটি জেন্ডার ইস্যু হিসেবে দেখতে শুরু করলাম। এখন আমার ২৬। এতোগুলো বছরে ২-১ বারের বেশি আমিও কখনো মাকে ঘুমাতে যেতে কিংবা ঘুম থেকে উঠতে দেখিনি। অসুখ-বিসুখ, পালা-পার্বণ, আনন্দ- উৎসব যাই থাকুক, তার কোন ছুটি নেই। একই রুটিন তার, ভোরে ওঠা, অনেক রাতে ঘুমাতে যাওয়া।

মাকে এখনো দেখি, বাড়ির সকলকে খাইয়ে সে ঘুমাতে যায় আবার কাঁকডাকা ভোরে উঠে পড়ে নাস্তা বানানোর চাপ মাথায় নিয়ে। এদিকে বাবা ওঠেন বেলা করে। তিনি যখন ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র বসবেন নাস্তার টেবিলে, ততক্ষণে মায়ের বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার, সমস্ত কাজ প্রায় শেষের দিকে। দুপুরের রান্নার তোরজোড়ও শুরু হয়ে যায় ততক্ষণে। আচ্ছা, মায়েদেরও কি মাঝেমাঝে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে ইচ্ছে করে না? ইচ্ছে করে না সমস্ত কিছু একপাশে রেখে একটু তাড়াতাড়ি বিছানায় এলিয়ে পড়তে? তারা তো মেশিন নয়, বাবাদের মতোই রক্তে-মাংসের শরীর তাদের।

যাই হোক, এ তো গেল আমার গৃহিনী মায়ের কথা, কর্মজীবী নারীদের অবস্থা কেমন হয়? তারা কি ঠিকঠাক ঘুমাতে পারে? না। স্টাডি বলছে, কর্মজীবি নারীদের ঘুমের অবস্থা আরো ভয়াবহ। বাইরের কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজগুলোও করে যেতে হয় তাদের। ঘরের কাজ, রান্না-বান্না, বাচ্চা লালন-পালন, এসব দায়িত্ব থেকে যেন নারীর পালানোর কোন পথই নেই। ফলে দেখা যায় যে, কর্মজীবি নারীদের পুরুষের তুলনায় ঘরে ও বাইরে বেশি খাটতে হয়। পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিও ব্যয় করতে হয় তাদের। আর এ কারণে নারীর ঘুমও বেশি প্রয়োজন হয়। যা কিছু প্রয়োজন, কবেই বা তা পেয়েছে নারীরা!

কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, আফগানিস্তানসহ অনেক জায়গায় যেখানে নারীর শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলোই আদায় হয় না, সেখানে ঘুমের অধিকার চাওয়াটা বিলাসীতা। তা বলুন, কিন্তু জেনে রাখুন ঘুমও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

নেপোলিয়ন বলে গেছেন, “তাকে ঘুমাতে দাও, কারণ সে যখন জেগে উঠবে, তখন সে পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেবে”। যদিও তিনি কথাটি চায়নার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তবে আমি মনে করি, এটা নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। একটি ভালো ঘুম, একটি ভালো দিনের, একটি ভালো কাজের পূর্বশর্ত। পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম নিশ্চিত হলে নারী জীবনের অর্ধেক সমস্যাই অটোমেটিক্যালি কমে আসবে। তারা শুধু সুস্থভাবে বাঁচবেই না, উন্নতিও করবে।

(এই লেখাটির ইংরেজি সংস্করণ ডেইলি স্টারে ছাপা হয়েছে)

শেয়ার করুন: