বোরখা বা হিজাব আসলে কীসের সাইনবোর্ড?

মুশফিকা লাইজু:

যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবদমিত, নিগৃহীত এবং অবমূল্যায়িত নারীরা স্বভাবতই তাদের কমবুদ্ধির বিচারে আপামর জনতার কাছ থেকে সম্মান পেতে ও ভালো মেয়ের তকমা লাগাতে উন্মুখ বা লোভাতুর হয়ে থাকে। আর সেই লক্ষে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ সস্তা ও শর্টকাট পথ হলো নিজেকে আপাদমস্তক মুড়িয়ে রাখা বা এককথায় বোরখা। সেই প্রহসনমূলক সম্মান আর রাস্তাঘাট, মূর্খ সমাজ আর অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবারে ভালো মেয়ের তকমা পেতে কোনো শিক্ষা, জ্ঞান বা শৈল্পিক চর্চার প্রয়োজন হয় না। কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, নেই সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখার কোন প্রচেষ্টা। শুধু একখণ্ড কাপড় দিয়ে নিজেকে ঢেকে দাও, ব্যস। জাগতিক পুলসিরাত পার।

অথচ সমাজে বা পরিবারে বা রাষ্ট্রে খারাপ মেয়ে বা কুলটা মেয়ে বলে চিহ্নিত নারীরা যা যা করে একজন বোরখা পরিহীতা নারী সেই সকল কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখে না, বরং আরো বিপুল বেগে করে। কারণ বাজারে চিহ্নিত কসাইরা নিয়মে-অনিয়মে যখন পশুবধ করে তখন সামাজিক পুলিশেরা কসাইয়ের কাজকে হালাল বলে নিশ্চিত করে।

বোরখা হালাল!! অপরাধের একটি সমাজ ও ধর্ম স্বীকৃত একটি প্রাথমিক সাইনবোর্ড। বোরখা বা নেকাব একটি অপরাধের ছাড়পত্র। নিজের সৌন্দর্যকে আড়াল করা বা লম্পট পুরুষের লালসাকে নিভৃত করার জন্য যদি বোরখাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় তবে বাংলাদেশের প্রসাধনী বিতানগুলোতে এতো হিজাবীদের ভিড় দেখা যেতো না। এতো এতো নীলনয়না আর রঞ্জিত কপোলের ঢাকনাওয়ালা নারীদের আমরা দেখতে পেতাম না। যদি সম্মান সম্ভ্রম রক্ষাই বোরখার প্রধানতম শর্ত হয় তবে পার্কে, আলো-আঁধারি ফুটপাথে, অন্ধকারাচ্ছন্ন সিনেমা হলে বোরখার তলদেশে তথাকথিত প্রেমিক বা ভাড়াকরা নাগরের হস্তের এতো সঞ্চালন দেখা যেতো না।

সর্বজন জ্ঞাত, যৌনকর্মীদের মানবাধিকার ও জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে আমি কাজ করে থাকি, সেখানে আমার সাথে যুক্ত যতজন যৌনকর্মী বন্ধু বা বোন আছেন তাদের সকলের এক বা একাধিক বোরখা আছে যা তাদের পেশাগত পোষাক হিসেবেই বিবেচিত। কারণ তাদের আড়ালের প্রয়োজন আছে, আড়াল ছাড়া তারা আপনাদের সমাজে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারবে না। আপনারা দেবেন না। আবার আমি দলিত এবং পরিচ্ছন্ন কর্মী নারীদের সাথেও কাজ করি। বিশ্বাস করুন, আমি আজ পর্যন্ত সেইসব নারীদের মধ্যে যারা মুসলিম, তাদের কাউকেই বোরখা পরতে দেখিনি।

নব্বই দশক পর্যন্ত বোরখার এতো রমরমা উত্থান আমরা দেখিনি। তখন মূল্যবোধের এতো ভঙ্গুরতাও চোখে পড়তো না। সময়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক ও যাপন সংকট বেড়ে যাওয়াতে সমাজের মূলস্রোতে নারীদের পদচারণা বাড়ছে; কিন্তু সমান তালে দৌড়াতে গিয়ে নারীর জ্ঞান, দক্ষতা ও শিক্ষার ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। প্রগতির সাথে নারীর অগ্রগতির যখনই সংঘর্ষ শুরু হয়, তখনই একদল অন্তরালের প্রগতিবিরোধী শয়তান ধর্মের বস্তাপচা ধান্দা নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক দু:শাসন কায়েম করার জন্য নারীর স্বল্প শিক্ষা বিবেচনায় অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বোরখার মত জিঞ্জির চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে দিগবিদিক জ্ঞানহীন নারী আপাত:ভ্রমে বোরখাকে বর্ম হিসেবে গায়ে চড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতেও পারেনি যে তাদের অহমকে আরও ভারী ও কলুষিত করেছে এই বোরখা। কারণ এই একই পোশাক অপরাধের সাথে যুক্ত নারীদের দশদিগন্তের সাথে আরও একটি পালক যুক্ত হয়েছে।

নারী যদি নিজেকে একবারের জন্যও মানুষ ভেবে থাকে, একবারের জন্যও নিজেকে সম্মান করে থাকে, তাহলে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া কাপড়ের জিঞ্জির অচিরেই ভেঙে ফেলবে। এটা আমি বিশ্বাস করি।

যদি জানতাম বেহেস্ত দোজখ বা স্বর্গে পুরস্কার প্রাপ্তির নিমিত্তে লোভাতুর হয়ে নারীরা বোরখাকে লেবাস হিসেবে নিয়েছেন, তাও কথা ছিল। বোরখার বিষয়ক ওহি-টি প্রায় জোর করে নামিয়ে আনা হয়েছিল তৃতীয় খলিফা ওমরের এক অসংযত কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে। তিনি রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়া নবীর এক সুন্দরী পত্নীকে দেখে ফেলেছিলেন এবং কী বলে ফেলেছিলেন তা নিরাপত্তাজনিত কারণে বিস্তারিত লিখলাম না। তো, বিষয়টি অসম্মান বিবেচনায় ঐ সপ্তাহের মধ্যেই নারীদের নিজেদের আড়াল করার নির্দেশটি আসে এবং শুধুমাত্র নবী পত্নীদের জন্যই এ ব্যবস্থা। এমনকি তার দাসী প্রেয়সীদের জন্যও নয়। পরবর্তীতে সম্ভ্রান্ত পরিবারের তকমা হিসেবে ধর্ম সংশ্লিষ্ট নারীরা কাপড় দ্বারা যেভাবে নিজেদের আচ্ছাদিত করেছিলেন, সেটা মোটেও আজকের দিনের বোরখার মত নয়। বড় কোন কাপড়ের টুকরা দিয়ে নিজেদের আড়াল করতো, যেমন ওড়না।

নবী পত্নীরা জীবিত অবস্থায় নিশ্চিত বেহেস্তে যাওয়ার বার্তা পেয়েছিলেন, সুতরাং বেহেস্তের প্রলোভনে তারা নিজেদের ঢাকনা দিয়ে রাখতেন। কিন্তু আজকালকার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘মস্তিষ্কবিহীন’ ঘূর্নায়মানেরা কোন বার্তা ছাড়াই আপামর পুরুষদের চরিত্র সুস্থির ও লম্পটদের লালসাকে নিভৃত করার ইজারা কেন নিয়েছেন?

শেয়ার করুন: