ফারদিন ফেরদৌস:
আপনি যেহেতু মুখ দেখাবেন না বাইরে যাওয়ার কী দরকার? বাইরে গেলে এনআইডি কার্ড করতে হয়, পাসপোর্ট লাগে, ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে, বিদেশ গেলে ভিসা লাগে; সবকিছুতেই মুখ দেখানো বাধ্যতামূলক। এমনকি হজ্বে গেলেও মুখ দেখাতে হবে। ২৫/৩০ লাখ পিলগ্রিমসের মধ্যে কেউ মিসিং হয়ে গেলে খুঁজবে কিভাবে মুখ না দেখালে?
এমনকি দেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, শপিং মল, এটিএম বুথ ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় নিরাপত্তার জন্য ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো থাকে। মহাসড়কগুলোয় যান চলাচলের বেপরোয়া গতি এবং অপরাধী গমনাগমন মনিটরিং এর জন্য সিসি ক্যামেরা থাকে। এসব সিসি ক্যামেরায় নিরাপত্তা বিধানের প্রধানতম শর্ত হলো মুখ খোলা রাখতে হবে।
তাহলে ধর্মের দোহাই দিয়ে (যদিও পৃথিবীর কোনো ধর্মই নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে মুখোশধারী হতে নির্দেশনা দেয়নি) যারা কাপুরুষের অশালীন ও অভব্য চোখ থেকে নিজেদের মুখরক্ষা করতে চান, তারা বাড়ির বাইরে আসবেন না সেটাই তো স্বাভাবিক। যদিও মানবতাবিরোধী এমন কথা বলা কিছুতেই উচিত নয়, তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ বোধহয় অমনটাই বলতে চায়।
নারীকে নিতান্তই ঘরের বাইরে আসতে হলে বাবা, ভাই, পুত্র অথবা স্বামীকে সাথে নিয়ে বাইরে আসতে হবে। যাতে সঙ্গীয় ওই পুরুষ মানুষটি নিরাপত্তা জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব দিতে পারেন। পুরুষের ভাষায় অবলা ওই নারীকে পুরুষ রক্ষা করতে পারে। কিন্তু যাদের এমন পুরুষ নেই, অথচ সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে কাজের সন্ধানে বাইরে আসতে বাধ্য তারা মুখ লোকাবেন কিভাবে জানি না। রিলিজিয়াস তরিকা মেনে Veil করবেন ঠিক আছে। এটা করা আপনার অধিকার, তবে মুখঢাকা কিছুতেই নয়।
যদিও আধুনিক সভ্য সমাজ নিজের ধর্মীয় পরিচয় সাধারণে প্রকাশ করবার বিধি আইন করে বাতিল করে রেখেছে সেই ঊনবিংশ শতকের গোড়াতেই। তাদের কথা হলো বিদ্যায়তনে ধর্মীয় চিহ্নের ব্যবহার করা যাবে না। শ্রেণিকক্ষে পোশাক দেখে কারো ধর্মবিশ্বাস বুঝতে পারা উচিত নয়। কারণ ধর্মীয় পোশাক বা চিহ্ন শিশুদের মনে মারাত্মক বিভেদ সৃষ্টি করে।
তাহলে সেই বিভেদের ধারাবাহিকতায় প্রাপ্তমনস্ক মানুষ হয়েও মুখ লুকিয়ে রেখে নিজের ও অন্যের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবেন -এর নাম কি ধর্মাচার? এটা কি আদৌ অধিকার?
যারা অতর্কিতে হামলা করে মানুষ মার্ডার করে, অপরাধী হয়, ব্যাংক বা এটিএম ডাকাতি করে, অপহরণ করে, এমনকি বাঁচার তাগিদে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপুরুষের রুচির দাসত্ব যারা মানে -এরা সবাই মুখ ঢেকে রাখে। আপনি যে তাদের দলের না বরং সাদাসিধে সহজ সরল সাধারণ মানুষ সেই বাছবিচার কীভাবে করা যাবে?
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, মিশর, মরক্কো ও সৌদিআরবে নারীরা মুখ ঢেকে রেখে নিজেদেরকে হাইড করে না। হঠাৎ করে আমাদের এলাকায় কী এমন বদ বাতাস লাগলো যে নারীর জন্য বিদ্যায়তনিক ড্রেস ছুঁড়ে ফেলে পুরোদস্তুর অবগুণ্ঠিত হয়ে থাকতে হয়?
এখানকার পুরুষেরা খারাপ। নারীর মুখ বা হাত দেখলেই তারা সিডিউসড হয়ে যায়, তাই তো? তাহলে এই দোষটা কি পুরুষের, নাকি নারীর? পুরুষ তার চরিত্র শোধন করবার কথা না বলে নারীর মুখঢাকা নিয়ে পড়ে আছে কেন? ৪০° তাপমাত্রার অসহনীয় গরমে পুরুষ নিজে ফিনফিনে পাতলা জামা পরে খোমা মোবারক দেখাতে দেখাতে চারিধারে ঘুরে বেড়ায়, অথচ যত পোশাকি আইন সেটা নারীর বেলায়। ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে পুরুষ তার চোখ আনত রাখে না। অন্যের কন্যা, জায়া, জননী, ভগ্নি, বৃদ্ধা নির্বিশেষে সবার দিকে কুতকুতে চোখ আর লকলকে জিহ্বা বের করে তাকায়।
এইসময় এ এক ভয়াল বাস্তবতা। কাপুরুষের জ্বালায় আমরা বউ বা কন্যা নিয়ে বাইরে বেরোতে পারি না। কী অফিসার, রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুর, মৌলভি সবাই ছ্যাবলার মতো হা করে তাকিয়ে থাকবে। যেন জীবনেও নারী দেখাটা ভাগ্যে জোটেনি। সাথে যে একজন মাহরাম পুরুষ আছে তাকেও গোণায় ধরে না এসব নিলাজ হ্যাংলারা!
এই সমাজের বেশিরভাগ পুরুষেরা এমন কেন হলো?
নারীর প্রতি মাতৃ বা কন্যাসুলভ অ্যাটিচ্যুড প্রকাশ না করে কালো কাপড়ে ঢেকে দিতে চাইছে কেন? কারা এই বাজে মতলব শেখাচ্ছে এদের। সোশ্যাল মিডিয়ার বকবক থেকে অপড়ুয়া এরা কী শিখছে আসলে? দেশের বিদ্যাপীঠগুলোই বা কী ছাইপাশ শেখাচ্ছে?
আমরা মনে করি দেশের রাজনীতি যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পাওয়া সাংবিধানিক ভিতের ওপর শক্তপোক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকত, পলিটিশানরা যদি সত্যি বলত, সাধু হতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইশকুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকরা যদি কূপমন্ডুকতা না ছড়াত, লাগামছাড়া ওয়াজ মাহফিলে মিসোজিনিস্টরা স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী না হতো এবং সর্বোপরি দেশে যদি আইনের শাসন থাকত; এই বিংশ শতাব্দীতে এসে গরমের দেশে মানবশরীরের জন্য চরম অস্বাস্থ্যকর কালো অবগুণ্ঠনকে নারীরা বেছে নিত না।
এই দেশের নবতর ধর্মজীবী ছেলেরা নারীর দিকে নিশ্চয়ই সম্মানের চোখে তাকায় না। নারীর প্রতি সহিংসতায় বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না তাদের! কার্যত মুখ খোলা নারী না ইহকালে, না পরকালে নিরাপদ বোধ করে না আর। অগত্যা কালো নেকাবে ঢেকে যাচ্ছে মা ও মেয়েদের পবিত্র মুখ। কার্যত শিক্ষায়তনে ছাত্রী ও শিক্ষক কেউ কাউকে চিনছেন না, কাকে কী পড়াচ্ছেন? কে কেমন অনুধাবন করছেন শিক্ষকরা আর তা জানতে পারছেন না। পাবলিক পরীক্ষায় আইডেনটিটি প্রোভ করবার রাষ্ট্রীয় দায় থেকে নেকাব খুলতে বললে প্রায়শই শিক্ষক ও ছাত্রীর মধ্যে বচসা হচ্ছে।
৫০ বছর আগেও এইদেশে এমন পরিস্থিতি ছিল না। সোহরাওয়ার্দী-শেরেবাংলাদের জামানায় রাজনীতিতে ঔপনিবেশিক জ্বালা ছিল। কিন্তু আপামর জনসাধারণ সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এখনকার চেয়ে বেশ আধুনিক ছিলেন। চিন্তা ও ভাবনায় ছিলেন অনেক বেশি প্রাগ্রসর ও যুক্তিবোধসম্পন্ন।
নারী যদি তার বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা হারিয়ে ফেলে, এমনকি শিক্ষককেও পিতা বা মাতার সম্মানে না রাখতে পারে কেবলমাত্র এক টুকরো কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে আমাদের বোধের অবনমন ঠেকানো যাবে না।
মানবিক অগ্রগতির জন্য পুরুষের দাসত্ব ভেঙে নারীকে অতি অবশ্যই চারদেয়ালের বাইরে আসতে হবে। চাকরি বাকরি ও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মাহরামের বিধিলিপিও তার পক্ষে মান্যতা দেয়া অসম্ভব। পুরুষ সঙ্গীকে সাথে নিয়ে অফিস করা, ক্লাস করা বা পরীক্ষার টেবিলে বসা যায় না। ধর্মীয় রুলস মতে, পুরুষকে নারীর ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এই যুগে এসে সেই রীতিও আর খাটে না। যেখানে দেশের প্রধান নির্বাহিই নারী। নয় কোটি পুরুষই তাঁর অধস্তন।
তাহলে পৌরাণিক রীতির এত অসম্ভবের কালে কেবলমাত্র নারীর মুখ ঢাকা নিয়েই পুরুষকে পড়ে থাকতে হয় কেন? তাদের আর কোনো গঠনমূলক কাজ বা যৌক্তিক চিন্তাভাবনা থাকতে নেই?
মুখ না ঢেকে নারী যদি ধর্মীয় বিধান মেনে ঢিলেঢালা শালীন পোশাক পরেই (যদিও সেনা, নৌ, বিমান ও পুলিশে থাকা নারী অফিসার বা কর্মীদের ঢিলেঢালা মুখঢাকা পোশাক পরা একেবারে অসম্ভব) ক্লাসে যায়, কাজ করে সংসার চালায় -তাতে পুরুষের কি ক্ষতি? ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব কি একলা পুরুষের? নারীকে কিছুই বুঝতে দেয়া হবে না?
আধুনিক জিনেটিক বিজ্ঞান বলছে, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও অ্যাটিচ্যুডের প্রায় পুরোটা আসে মাতৃপক্ষ থেকে। তাহলে সেই মাকে অবগুন্ঠিত, লাঞ্ছিত ও হেয় প্রতিপন্ন করে মানুষের জন্য কী লাভ বয়ে নিয়ে আসছেন হে পুরুষপ্রজাতি?
নারীকে পুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ ছাড়াই স্বেচ্ছায় ঘরের বাইরে আসতে হবে। এবং তার নিরাপত্তার স্বার্থেই নেকাব এভয়েড করতে হবে। মনুষ্য পদবাচ্যের জন্যই এটা জরুরি। ১৯২৯ সালে ‘নারী জীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’ শীর্ষক প্রবন্ধে মিস ফজিলতন নেস এম. এ ‘শিখা’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘নর-নারী সকল ক্ষেত্রেই পরস্পরের Complement. কাজেই তাদের কর্মক্ষেত্র বিশিষ্টরূপে সীমাবদ্ধ করে দেয়া যায় না। নারী যদি তার জীবনের পূর্ণ বিকাশের পক্ষে বহির্মুখীতাকেও প্রয়োজনীয় মনে করে, তাহলে তো তার বিরুদ্ধে কোনো কথা চলে না। আর যে শিক্ষা তাকে এই প্রয়োজনটুকুর কথা ভাবতে শিখিয়ে মনুষ্য পদবাচ্য করে তুলেছে বলেই আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ বর্তমান নারী জীবনে কাম্য হয়েছে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বলতেন, ‘ভয়কে কর জয়, জাগো গো ভগিনী!’ শতবর্ষ আগে বলা এই কথাটিই এখন বেশি প্রাসঙ্গিক। পুরুষ ধর্মের ডর দেখাবে বলে নারীকে ঘর বা অবগুণ্ঠনের ঘেরাটোপে সেঁধিয়ে যেতে হবে কেন? নারীর জীবন আলাদা। সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তার একার। ক্লাস বা পরীক্ষায় মুখ দেখালে জাত যাবে এমন দুর্মর ভাবনা তার সৃষ্টিশীল মাথায় আসবে কেন? পুরুষ যদি নারীকে নিজের শ্মশ্রুশোভিত খোলামেলা মুখ, রোমশ বুক, মাথার গোছানো কেশরাজি বা পায়ের টাকনো দেখানোকে পাপের কাজ না মনে করে, কেবলমাত্র নারীর মুখচ্ছবিতেই তার এত অস্বস্তি কেন হবে?
ঈশ্বরের আদেশপত্রের নামে হাজার বছর ধরে পুরুষেরা নারীকে অন্ধকারে রাখবার প্রয়াস পেয়ে আসছে। তাদের ঠেকাতে বেগম রোকেয়াকে অসঙ্কোচ ও নির্দ্বিধায় মন ও মগজে মান্যতা দিন হে মাতৃকূল। যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।
ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই; বলো ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
১. শিখা সমগ্র,
সংকলন ও সম্পাদনা: মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
২. বেগম রোকেয়া রচনাবলী,
সম্পাদনা: আব্দুল কাদির
৩. যার যা ধর্ম,
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
৪. মুক্ত-মন,
সংকলন ও সম্পাদনা: আরজ আলী মাতুব্বর
৫. শরীর: বাসিন্দাদের জন্য একটি নির্দেশিকা,
বিল ব্রাইসন
লেখক: সাংবাদিক
১৫ ভাদ্র ১৪৩০ | ৩০ আগস্ট ২০২৩