নারী কবে উঠে দৌঁড় দিতে শিখবে!

বাসন্তি সাহা:

এবার শ্রাবণে ভাবনার অপচয়
পুরোনো সন্ধ্যে ভাঙিয়ে নিয়েছি জলে (শ্রীজাত)

বাংলাদেশের নারীদের মৃত্যুর পরে যমরাজ যদি প্রশ্ন করেন, কী করেছিস সারাজীবন? নিজের দিকে তো তাকাসনি? শ্রাবণের বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখেছিস? না যমরাজ। সময় হয়নি।

তাহলে কী করেছিস?

‘বৃষ্টির দিনে বাচ্চাদের স্কুলে নিতে খুব কষ্ট হতো। রিকশা পাওয়া যেতো না। রাস্তায় জল উঠে যেতো। তারপর সাহায্যকারী আসতো না। সবকিছু মিলে সময় করে উঠতে পারিনি। তাহলে যা তোকে কুম্ভীপাক নরকে নিক্ষেপ করলাম’।

‘ঠিক আছে যমরাজ। আমার সমস্যা হবে না। স্বর্গে কোনো কাজ নেই । ওখানে গিয়ে আমি থাকতে পারবো না’।

মার খেয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছিলেন। সুস্থ হয়ে উঠে স্ট্যাটাস – ছেলেকে উদ্দেশ্যে করে লিখেছেন, ‘বাবা, আমি তোদের সাথে আছি’। স্বামীর বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে, তাদেরও শিক্ষা দেবে এমন একটা স্ট্যাটাস। জানা গেলো বহুদিন, বহু বছর ধরে মার খেয়ে আসছেন, তবু স্বামী-পুত্র নিয়ে, সোনার সংসার নিয়ে কিছু বলবেন না। এই অবস্থা একজন কর্মজীবী নারীর। ঘটনাটা সাম্প্রতিক।

পরিজন যারা থানায় অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন, থানা থেকেও বলা হয়েছে, মায়ের টাকা ছেলে নেবে না তো কে নেবে? স্বামী নেবে না তো কে নেবে? স্বামী মারবে না তো কে মারবে? ফেসবুকে কেউ কেউ এটাকে নিছকই পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেছেন।

খুব ছোটবেলায় প্রায় ত্রিশ বছর আগে খেলতে খেলতে পাশের বাড়িতে দেখেছিলাম স্বামীর হাতে বাঁশ। বউটি মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে । পাশে অনেক লোক দাঁড়ানো। স্বামী সবাইকে বলছে, কাজ থেকে ফিরে যদি উল্টোপাল্টা কথা শুনতে হয় তাহলে কি মাথা ঠিক থাকে! উপস্থিত সবাই একমত হলেন যে এমতাবস্থায় বাঁশ দিয়ে প্রহারই উপযুক্ত হয়েছে। কেবল আমিই ভাবছিলাম –আচ্ছা উনি তো উঠে দৌঁড় দিতে পারতেন! কেন দিলেন না!

আমি ভাবছি এই শ্রাবণটা কেটে গেলে পথ শুকোবে। তখন নারীরা নিশ্চয়ই উঠে একটু দৌঁড়ে দূরে যাবে। না কি যাবে না! আমার পরমপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–
স্ত্রীকে যদি আবশ্যক জ্ঞান করি তবে স্ত্রী দাসী,
স্ত্রীকে যদি ভালোবাসি তবে সে লক্ষ্মী”।

আমরা আসলে লক্ষ্মীরূপে ত্রিভুবনে বিরাজ করতে চাই। দাসীরূপেও ঠিকঠাক। কারণ আমরা জেনেছি প্রাণের অনুকূলে এখানে কিছুই মিলবে না। তাই শীতল এই সংসারেই নারী আবিষ্কার করে নেয় নিজের ভালোলাগার এক টুকরো উপত্যকা।

মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে এই যে এতো জাগরণ, এতো শিক্ষা এই অঞ্চলের মাঠে-ঘাটে এলো, তবু কেন বিয়ের সময় বলে নিতে হবে, ‘তোমাকে বউ করে নিচ্ছি সংসার করার জন্য। বিয়ের পরে চাকুরী করা একদম চলবে না। তোমাকে চোখমুখ বেঁধে সংসার করতে হবে’। অথচ কিছুদিন আগেও সেই মেয়ে দিনে রাতে অনায়াসে ঢাকা-কুমিল্লা করেছে। আর আজ তার সামনের দোকানে যেতেও চরণদার লাগে।

বিষয়টি ভাবতে ভাবতে কিশোরী বয়সে পড়া সুকুমার রায়ের পাগলা দাশুর গল্পটা মনে পড়ে গেলো। স্কুলে পাগলাদাশুর সহপাঠী রামাপদর সাথে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু একদিন রামাপদ এক হাঁড়ি মিহিদানা নিয়ে ক্লাসে এলো। অনেক সাধাসাধির পর মিহিদানা নিয়েছিল পাগলাদাশু। মিহিদানা সে এড়াতে পারেনি। তেমনি সংসারেও এক হাঁড়ি মিহিদানা আছে। ওটাকে বাদ দিয়ে কিছুতেই বাঁচা যায় না। মনের মধ্যে যতই আলো আঁধারের খেলা থাক। অর্ধেক মনে বিষাদের অন্ধকার আর অন্যদিকে মিহিদানার মতো মিষ্টি সংসার। এই দোলাচলে কেটে যায় জীবন।

লেখাটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাবার কিছু নেই। এটা কমবেশি আমাদের। আটকাআটকি দেখে এলোমেলোভাবে মাথায় এলো। আমি এখন উঠে চা খেতে খেতে কবিতা পড়বো আর—মন মোর মেঘের সঙ্গী—। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাববো, আমাকে আজীবন এই ছকেই মাথানত করে বাঁচতে হবে এমনটা নয়। নিজের মধ্যেই সুন্দরকে খুঁজতে আবার সেই রবীন্দ্রনাথ-

আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে
নিশার মতো, নীরব ওহে, সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।

 

বাসন্তি সাহা
কেঅর্ডিনেটর-রিসার্স এ্যান্ড ডকুমেন্টেশন
দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা।

শেয়ার করুন: