#MeToo মুভমেন্ট এবং সিলেটের সাম্প্রতিক ঘটনা

সুপ্রীতি ধর:

সম্প্রতি সিলেটের নাট্য ও সংস্কৃতি পরিমণ্ডলের আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে লিটন নামের একজনের বিরুদ্ধে একাধিক নারীর প্রতি অশালীন আচরণের অভিযোগ উঠেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে তাকে পদ থেকে অব্যাহতিও দেয়া হয়েছে। যদিও বরাবরের মতোই সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে যে কিছু কুচক্রিমহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। খুবই পরিচিত এই অভিযোগ খণ্ডনের বিষয়টি।

খবরটি ছিল এরকম:

“সিলেটের নাট্যসংগঠক ও আবৃত্তিকার আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে লিটনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন ও নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেট এবং সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেট যৌথভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে এ অভিযোগ করেছে। এর আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আমিনুল ইসলাম চৌধুরীকে সংগঠনের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ প্রকাশিত হয়। এ কারণে তাঁকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে”।

– খুবই সময়োপযোগী এক সিদ্ধান্ত। সেইসাথে আমাদের মনে রাখতে হবে যেসব মেয়ে এসব অপকর্মের কথা তুলে ধরে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার কর্তব্য। অথচ আমরা ভুলে যাই সেইসব মেয়েদের মানসিক জগতের বিষয়টি, যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে তাকে এপর্যন্ত কাটাতে হয়েছে, কাউকে বলতে পারেনি সেইসব দিনগুলোর কথা, যখন একটা শিশু নিজেই বুঝতে পারে না কেন তার শরীর তারই শত্রু হয়ে উঠলো, যে কারণে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে পুরোটা জীবন, সেই বিষয়গুলো আমরা ভেবে দেখি না। যে ক্ষতি তাদের হয়ে যায় এরকম একেকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে, সেই জায়গাটি নিয়ে অনেক কাজ করার থাকলেও আমাদের সমাজ, রাজনীতি কোনটাই তা নিয়ে উৎসাহী নয়। এমনকি আমরা যারা মোটামুটি সোচ্চার থাকি সবসময়, তারাও আজকাল সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই। মনে হয়, কী হবে আর লিখে! এই যে অনীহা, এটাও আমাদের মধ্যে খুবই সুপ্তভাবে বপন করে দেয়া হয়েছে প্রতিনিয়ত আমাদের নিয়ে ট্রল করে, গালিগালাজ করে।

ফিরে আসি প্রসঙ্গে।

ফেসবুকে একাধিক নারী ও সিলেটের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এই আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে যৌন নিপীড়ন ও নারীদের প্রতি অশালীন আচরণের অভিযোগ এনে পোস্ট দিয়েছেন। তাছাড়া বেশ কয়েকজন ভিকটিমের বক্তব্য এবং অডিও শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। অডিও’র বক্তব্য শুনতে গিয়ে নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে। আরও মনে হয়েছে, যে মেয়েটি বা যেসব নারী এই অভিযোগগুলো করছেন তারা এতোগুলো বছর ধরে এই বিষয়টা মনে চেপে রেখেছেন, কী অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগেছেন সারাটা জীবন! এরকম একেকটি ঘটনা পুরো জীবনটাই তছনছ করে দেয়। অডিওটি শোনার সময় মেয়েটির কেঁপে কেঁপে উঠা গলার স্বর আমাকেও বিপর্যস্ত করেছে। নিজের শৈশবের সেই ভয়াবহ দিনগুলো যেন খুঁজে পেয়েছিলাম আরেকজন নারীর কণ্ঠে। খুবই বিচলিত বোধ করেছি।

মন্দের ভালো যে মেয়েরা আজ সেইসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এসে কথাগুলো বলতে পারছে। তাদের কথাগুলো আমলে নিচ্ছে অন্যরা। পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে। অথচ এই ২০১৮ সালেই যখন আমাদের দেশে মিটু মুভমেন্টের আঘাত আছড়ে পড়েছিল, কী ভয়াবহভাবে সেইসব মেয়েদের সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছিল সবাই একাট্টা হয়ে, এক মানসিক যন্ত্রণা থেকে আরেক যন্ত্রণায় তাদের ফেলা হয়েছিল, এতো নিজের জীবন থেকেই শেখা আমার।

সাধুবাদ ও স্যালুট জানাই সিলেটের আপামর সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মীদের, যারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা যে মেয়েগুলোর বিরুদ্ধে স্লাট শেমিং করেনি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সর্বোপরি সেই অভিযুক্ত, তথাকথিত মুখোশ পরা সুশীল সংস্কৃতি কর্মীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ থেকে অন্যরা যারা এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে এখনও, তাদের সাবধান হওয়ার সময় এসেছে, নিজেকে শোধরানোর সময় হয়েছে।

আশা করছি এভাবেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে সাহস পাবে, এগিয়ে আসবে সমাজের এই নরাধমদের চিহ্নিত করতে। এই লিটনের মতোন লাখ লাখ লিটন মুখে সংস্কৃতির মুখোশ পরে আছে, তাদের সেই মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলাও আমাদের একান্ত কর্তব্য।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন: