সস্তা সংলাপের নাম যখন “ভালোবাসি”

ওয়াহিদা সুলতানা লাকি:

বর্তমান যুগে ফ্রি ম্যাসেঞ্জারের সবচেয়ে সস্তা সংলাপের নাম হলো “ভালোবাসি”।

অথচ আমরা কি আদৌ জানি নারী-পুরুষের এই ভালোবাসার অর্থ আসলে কি? এর অবস্থান আসলে কোথায়?

প্রথমে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেই।

ভালোবাসার অবস্থান আপনার মস্তিষ্কে; অবশ্যই হৃদয়ে নয়। যাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন সে আসলে আপনার বুকের বা পাশে অবস্থান করেন না, জাস্ট মস্তিষ্কে অবস্থান করেন। তাই আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে তার স্মৃতি ব্যতিত আপনি চলতে পারেন না, চাইলেও স্মৃতিভ্রম ব্যতিত তাকে ভুলে যেতে পারেন না।

প্রথম দেখাতেই কখনও ভালোবাসা হয় না। তবে যেটা হয়, সেটাকে গবেষকরা ‘লোভ’ বলেছেন। প্রথম দেখার পর ওই মানুষটির যে স্মৃতি আপনি আপনার মস্তিষ্কে বহন করে নিয়ে এসেছেন এবং পরবর্তী সময়গুলোতে তাকে আর কিছুতেই ভুলতে না পেরে একরকম ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হতে থাকে সেটাকেই ‘ভালোবাসা’ বলে।

এবার আসি “ভালোবাসার আক্ষরিক অর্থটি কী?”

প্রথমত ভালোবাসা শব্দটিকে দু’ভাগ করুন। ‘ভালো’ এবং ‘বাসা’। বাসা হচ্ছে ‘বস’ ক্রিয়া থেকে সৃষ্ট। যেমন কোন ঘরে বসা বা বাস করা। ‘ভালোবাসা’ বলতে আপাতদৃষ্টিতে বোঝায়, কোন ঘরে ভালোভাবে বাস করা বা একসঙ্গে থাকা।তার মানে এটুকু পরিস্কার যে ভালোবাসার প্রথম শর্তই থাকবে একসঙ্গে থাকার একটা উদ্দেশ্য। যা কখনোই অনলি টাইম পাসিং কিংবা সুযোগের সদ্ব্যবহার নয়। যেখানে দুদিন পরই “তোমাকে আর ভাল্লাগছে না, “আমার পরিবার তোমাকে মেনে নিবে না”, “আমি তোমার কথা পরিবারে জানাতে পারবো না”, “আগে ক্যারিয়ার গুছিয়ে নেই”, “তোমার চরিত্র ঠিক নেই”,” আমার এখন পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনের সময়”, তোমাকে যেমনটি ভেবেছিলাম তুমি আসলে তেমনটি নও…” এই জাতীয় গবেট মার্কা কথাবার্তা বলে সটকে পড়ার কোন সুযোগ নেই।

ভালোবাসার অনুভূতি আপনার হতেই পারে, তবে ওয়াইজ হবে আগে থেকেই সবটা নিজের সাথে বোঝাপড়া করে নেয়া যে আদৌ আপনি ওই মানুষটিকে পাশে নিয়ে জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দিতে পারবেন কিনা! তবেই ভালোবাসার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে পা রাখা যেতে পারে।

ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে একটি শুভ পরিণতির উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাওয়া, কখনোই সব ভুলে গিয়ে আবেগে গা ভাসিয়ে সময় ক্ষেপণ কিংবা কারও ক্ষতি সাধন নয়।

এবার জেনে নেই আভিধানিকভাবে ‘ভালোবাসা’ শব্দটির ‘ভা’ কথাটি কোত্থেকে এসেছে? ‘ভা’ অর্থ ‘ভাল’ অর্থাৎ ‘কপাল’। যা দেখা যায়, যা অবশ্যই প্রকাশ্য। সেক্ষেত্রে ‘ভালোবাসা’ হচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত, যেখানে সারাটি জীবন আমি প্রকাশ্যে সেই প্রিয় মানুষটির সাথে কাটাতে চাই। কখনও কখনও ভালোবাসা গল্প, কবিতা, সাহিত্যের বিচারে গোপনে সংঘটিত হয়ে থাকলেও সেটা আসলে মূলত ভালোবাসা হতে পারে না, তার নাম ‘মোহ’। যা এক সময় কেটে যায়।

গবেষকদের মতে, ভালোবাসার আরেকটি উত্তরণ হচ্ছে  ‘ঘর করা’। ভালোবাসা কোনভাবেই নিজের শূন্য সময়ের পূর্ণতা ঘটিয়ে সুসময় এলে নিজ ক্যারিয়ার গুছিয়ে বেটার অপরচ্যুনিটির হাত ধরে সরে যাওয়া হতে পারে না।ভালোবাসায় কমিটমেন্টের সাথে সাথে কিছু দায়িত্ব থাকতে হয়। যেখানে চাইলেও পরিবার কিংবা সমাজের অজুহাতে সবটুকু সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে অপজিটের মানুষটিকে আঘাত কিংবা অপমান করার কোনরকম সুযোগ নেই। এই ‘ভালোবাসা’ অর্থ একসাথে ঘর করা আর যে ঘর করার মধ্য দিয়ে আগামী সন্তান-সন্ততি বৈধতা লাভ করে।

ভালোবাসার অর্থ না বুঝে একে এতো ছোট কিংবা ক্ষীণ করে দেখা উচিৎ নয়। যখন তখন যে কাউকে সাত পাঁচ আদ্যোপান্ত না ভেবেই ভালোবাসি… ভালোবাসি… বলে মুখে ফেনা তুললেই সেটাকে ‘ভালোবাসা’ বলে যেমন মেনে নেয়া যায় না, তেমনি বিশ্বাসও করাটাও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।

বহু গবেষক ভালোবাসার নানা রকম সংজ্ঞা রেখে গেছেন। মোদ্দা কথা, একটা মানুষ যখন আপনার সবটা জেনে, শুনে, বুঝেও আপনাকে ফেলে চলে যায় না, বুঝতে হবে সেখানে আপনার জন্য তার যে জমানো অনুভূতি সেটিই ‘ভালোবাসা’। এবার আপনার উপর নির্ভর করবে আপনি আপনার দিক থেকে ভালোবাসার সবটুকু তাৎপর্য পূরণ  করতে পারবেন কি পারবেন না।

ভালোবাসা মানে না কোন বর্ণ, বয়স কিংবা সামাজিক দোহাইয়ের অপ্রীতিকর অজুহাত। নারী-পুরুষের আজন্মকালীন এই অনুভূতি একদিন প্রকাশ্যে শুভ পরিণতির উদ্দেশ্যে দুটি হৃদয়ের চক্রযানে একই গতিতে আপন বেগে ছুটে চলার নামই ‘ভালোবাসা’।

ভালোবাসুন প্রাণ খুলে, নিজের সবটুকু দ্বিধা ভুলে,আজীবন পাশাপাশি থাকবার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।

(উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত সব লেখাই লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.