রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশে যা হতে পারে!

আলী আদনান:

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অধিকাংশ মানুষ কল্পনাও করেনি, পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ভূখণ্ডটা একদিন ‘বাংলাদেশ’ হয়ে যাবে৷ এমনকি ছয় দফা নিয়েও তাদের প্রবল আপত্তি ছিল। ৬৯ – এর গণঅভ্যুথান, ৭০ – এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় লাভের পরেও এখানকার জনগণের বড় একটি অংশ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো একটা দফা রফা করে আমরা পাকিস্তানের সাথেই থাকবো। না বললেই নয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও খোদ মুজিব নগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা খন্দকার মোশতাকরা চেয়েছিল পাকিস্তানের সাথে আমাদের একটা কনফেডারেশ হোক। সেজন্য সে মার্কিন বলয়ে লবিংও চালিয়েছিল।

হয়নি! ওদের অবিশ্বাস, ওদের না চাওয়া, ওদের দীর্ঘশ্বাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ!

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে একথা একসময় কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। যুদ্ধাপরাধীরা এদেশে বিভিন্ন সময় মন্ত্রী হয়েছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে হুংকার ছেড়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের অনেক বড় নেতাও ভাবতে পারেনি- কোন একদিন এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।

২০০৮-০৯ সালের দিকে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে কোথাও বললে অনেকে হাসাহাসি করতো। ট্রাইব্যুনালে যখন বিচার কার্যক্রম চলছে তখনো অনেকে বলতো, এদেশের মাটিতে ওদের বিচার অসম্ভব! স্বয়ং খুনীরাও বিশ্বাস করতো কখনোই কিছুই হবে না। সেই বিশ্বাস থেকেই কাদের মোল্লা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়েছিল!

হয়েছে! এদেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম সফল ভাবে হয়েছে।

এতো কথা এতোক্ষন এমনি এমনি বলিনি। বলার পেছনে একটা কারণ আছে। সময় অনেক কিছু ঠিক করে দেয়৷ ‘গায়ের জোর’ ও ‘সময়ের দাবি’ এককথা নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দুটোই ছিল সময়ের দাবি। যারা ‘কখনোই হবে না’ বা ‘হওয়া অসম্ভব’ বলে তারা গায়ের জোরেই বলে।

৭২- এর সংবিধান যদি সময়ের দাবি হয়ে উঠে কখনো সেটাকে গায়ের জোরে ঠেকাতে পারবে না কেউই। সময়ের নানা দিক ৭২- এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দরজাগুলো খুলে দিচ্ছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। যা হওয়ার হয়ে যাবে। ‘মানি না মানব না’ জাতীয় স্ট্যাটাস ফেসবুকে দিয়ে সময়কে ঠেকানো যায় না। ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সাঈদী সাহেব মুক্ত বাতাসে থাকতেন, সাকা চৌধুরী এখনো রাউজানের এমপি হতেন।

(দুই)
কিন্তু এখানে অন্য একটা প্রশ্ন এসে যায়। সেটা হলো উপরে যে দুটি উদাহরণ দিলাম দুটোর সাথেই ক্ষমতাসীন সরকার একমত পোষণ করেছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইস্যুটার কোন দিকে অবস্থান নিলে সরকারের লাভ সেটা সরকার নিজের জায়গা থেকেই চিন্তা করবে। এখানে ‘রাজনীতি’টা বড় কথা। আদর্শ নয়।

আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রয়োজনে নিজের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটা কেটে বাদ দিয়েছিল। আবার একই আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল বজায় রাখতেই ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছে। যে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িকতার আওয়াজ ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রধান নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে- সেই আওয়ামী লীগই দেশের মাটিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেছে।

অতীতের কথা বাদ দিই। সাম্প্রতিক সময়ের কথাই বলি। গণজাগরণ মঞ্চের সুফল ভোগ করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে হেফাজতকে কারা মাঠে উঠিয়েছিল বা পর্দার আড়ালে কারা স্বার্থ হাসিল করেছে তা সবার কাছেই স্পষ্ট। যে আওয়ামী লীগ শাপলা চত্বরে একরাতে বাবুনগরীদের ছত্রভঙ্গ করেছে সেই বাবুনগরীদের কাছ থেকেই আবার আওয়ামী লীগ প্রধান সংবর্ধনা নিয়েছে। দাবি দাওয়া মেনেছে অনেক ক্ষেত্রেই।

এগুলো বারবার নতুন করে বলার কিছু নেই। যেটা আসল কথা সেটা হলো আওয়ামী লীগ ইস্যু নির্ভর রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় থাকার জন্য ওরা ইস্যু নিয়েই রাজনীতি করে। স্বর্প হয়ে দংশন করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে। এতো দক্ষ খেলোয়াড় এ ভূখন্ডে ঠিক এই মুহুর্তে দ্বিতীয় কেউ নেই।

আগের কথায় ফিরে আসি। রাজনীতি সচেতন লোক মাত্রই মনে করছেন, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রধর্ম ইস্যুটা নিয়ে তাই করবেন যা ওনার দলকে ক্ষমতায় রাখার জন্য নিরাপদ। ওনি যদি মনে করেন তিনি দেশের সচেতন, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তবুদ্ধির চেতনা সম্পন্ন লোকদের মতামতকে প্রাধান্য দিলে ওনার ক্ষমতার স্বার্থে ভালো হবে তাহলে তিনি একরকম ভাববেন, আর যদি মনে করেন সারাদেশে নিজ দলের ভেতর ও দলের বাইরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষমতার দড়ির লাগাম নিজের হাতে রাখবেন তাহলে এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপারটি রাজনৈতিক এবং এখানে যাই হোক না কেন ক্ষমতার স্বার্থে হবে।

(তিন)
আচ্ছা ধরে নিলাম, আওয়ামী লীগ সরকার অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিল। সংবিধানে সোজা কথায় ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ থাকলো না। খুব ভালো! কিন্তু আওয়ামী লীগ তো চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। অন্য কেউ না কেউ ক্ষমতায় আসবে। গত পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের শিখিয়েছে এক সরকার যা করে যায় অন্য সরকার এসে তার বিপরীতটা করে। আওয়ামী লীগের অবর্তমানে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তা কোন অবস্থায়ই আওয়ামী লীগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি অসাম্প্রদায়িক হবে এটা দাবি করার কোন সুযোগ কিন্তু নেই। হাতে গোনা দু’একটি দল- যারা সবসময় নিজেদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের শক্তি দাবি করে তারা জনগণের মাঝে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে তো পারেই নি বরং দিনদিন তারা ঢোঁড়া সাপের মতো নামমাত্র রাজনৈতিক দলে পরিণত হচ্ছে।

সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অবর্তমানে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা জনগণের মাঝে নিজেদের জনপ্রিয় করার কৌশল হিসেবে কাজে লাগাবে ধর্মকে। যেমনটি আমরা দেখেছিলাম ৭৫ পরবর্তী নানা সময়ে। যেভাবে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বসেছে, যেভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আজান দেওয়া শুরু হয়েছে ঠিক সেভাবেই। এখন আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে ম্যানেজ করতে গিয়ে যা করছে তা হয়তো রাজনৈতিক অভিনয়। কিন্তু অন্য দল ক্ষমতায় আসলে যা হবে তা রাজনৈতিক অভিনয় থাকবে না। বরং তাই হবে বাস্তবতা।
অর্থাৎ, কোন সরকারই রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেওয়ার ঝুঁকি তো নিবেই না বা নিলেও তা বেশীদিন কার্যকর হবে না। বরং জনগণকে বিভ্রান্ত করতে কমবেশী সকলেই ‘ধর্ম’কে টেনে আনার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। এখানকার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার এবং রাষ্ট্রীয় কাজে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার বানানোর সম্ভাবনা – এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক।

(চার)

তাহলে? ধর্মকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে ধোঁকা দিয়ে যাবে? আর অন্যদিকে হাতে গোনা কিছু মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি ধারন করে এমন মানুষ কী সোশ্যাল মিডিয়ায় বা মাঝেমাঝে শাহবাগে মানববন্ধন করবে- এতোটুকুই?

জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। ধর্মবাজদের হাত থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে হলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষরা নিজেদের স্বাতন্ত্রিক পরিচয়ে রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে হবে। নাম সর্বস্ব ও জোট নির্ভর না হয়ে জনগণের মাঝে কীভাবে নিজেদের জনপ্রিয় করা যায় সেটা ভাবতে হবে। প্রধান রাজনৈতিক দল ( যারা কথায় কথায় ধর্মকে হাতিয়ার বানায়) তাদের বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
আমি যেটা বিশ্বাস করি, আমি যেটা চাই, যেটা আমার আদর্শ – সেটা অন্যকেউ বাস্তবায়ন করবে না। আমার আদর্শ বাস্তবায়নের ঝুঁকি আমাকেই নিতে হবে। শুধু প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন না করে আজিজ সুপার মার্কেটে আড্ডা না দিয়ে জনগণের আস্থার জায়গায় কীভাবে নিজেদের নেওয়া যায়- তা ভাবার বিকল্প নাই। এদেশে প্রগতিশীল মানুষ কম নয়। কিন্তু এদের সংগঠিত করার মতো কোন প্ল্যাটফর্ম নেই, থাকলেও সেটা সব শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এটাই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও ধর্মকে হাতিয়ার বানানো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা।

কঠিন তত্ত্বকথার দরকার নেই, নিজেদের অন্য অনেকের চেয়ে বেশি জানি, বেশি বুঝি এমন ভাবারও সুযোগ নেই। সাধারণ জনগণের মাঝে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করাই এখন একমাত্র উপায়।

আমি ভীষণ রকমের আশাবাদী মানুষ। নতুন দিনের নতুন আলোয় নতুন প্রজন্ম নতুন দাবিতে সোচ্চার হবে – এটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
যারা শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য বিজয় দিবস নিয়ে মাতামাতি করছেন তাদেরকে নয়, যারা মনে-প্রাণে সবসময় মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে আসছেন- তাদের সকলকে শুভেচ্ছা।

(আলী আদনান, লেখক, রাজনীতি সমালোচক, অ্যাক্টিভিস্ট)

শেয়ার করুন: