প্রিয়াঙ্কা দাস মিলা:
যথাবিহিত সম্মানপূর্বক, আজকে আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা শুনে আমার লিখতে ইচ্ছা হলো। বন্ধু একবার পাত্রীপক্ষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এজন্য আক্ষেপ করছেন। আমরা মেয়েরা কতভাবে, কত উদ্ভট কারণে প্রত্যাখ্যাত হই তার কোন ইয়ত্তা নেই। বন্ধুর ঘটনা শুনে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
তখন কেবলই মাত্র এইচএসসি শেষ করেছি। জীবনের প্রথম পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে, কিছুটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিলো, কারণ ততদিনে আমার বেস্টফ্রেন্ড এর বিয়ে হয়ে গেছে। সংসার জীবনের গল্প শুনি তার কাছে আর শিহরিত হই। যাই হোক, মূলকথায় আসি, আমাকে যে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে সে “পাত্র” আবার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, পড়াশোনা বড়জোর এইচএসসি পাশ। উফফ, তার ভীষণ ডিমান্ড তখনকার মার্কেটে। আমার মা তো ভীষণ আশাবাদী। আমিও সাথে দুই একটা স্বপ্ন দেখে ফেলেছি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে তার সাথে বরফ পানি খেলতেছি। তো পাত্র বাদে বাকি সব ব্যাটালিয়ন আসছেন মানে পাত্রের মা, ভাই, বৌদি, ভাতিজা – ভাতিজি সব মিলে ১৪ জন আসছেন। ছোটবেলা থেকেই মাঝে মাঝে আমি অভদ্র বা বেয়াদব হয়ে যাই। তো ‘তেনারা’ দেখতে এসে আমাকে বললো হেঁটে দেখাতে। আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম,’হেঁটেই তো আসলাম’। যেহেতু আমি সুন্দরী নই সম্ভবত এজন্যই তারা আমাকে ডিসকোয়ালিফাই করেছিলেন।। আহা, আমার বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন নিমেষে চুরমার হয়ে গেছিলো।
এরপর আমার জানামতে আমার বর আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তারপর আরেকদিন তিনি তার এক বন্ধুকে নিয়ে দেখতে এসেছিলেন, তারপর আরেকদিন তার ভাইকে নিয়ে দেখতে এসেছিলেন তারপর তার দাদী এসে ফাইনাল করেন আমাকে। আহা! বাপ-মা উদ্ধার হয়েছিলেন সেদিন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। যে মামা ঘটকালি করেছিলেন, তিনি একদিন তার (বরের) অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাথে আমার কাজিন ছিলো। তো আমার বর আমাকে আর আমার কাজিনকে দেখিয়ে তার এক কলিগকে বলেছিলেন, ‘দেখেন তো কোনটা পছন্দ হয়’। সেই কলিগ বলেছিলেন, “কোনটাই নয়”। সেদিন আমার নিজেকে গরু মনে হচ্ছিলো। এরপর থেকে আমাকে কেউ যদি সুন্দর বলে আমি ধরেই নেই টাইম পাসের জন্য হুদাই পাম্পপট্টি মারছে। যদিও আমার নিজেকে বাহ্যিকভাবে সুন্দর বানানোর আগ্রহ ছিলো না কখনো।
বরমহাশয় একান্তে আমাকে বলেছিলেন, পড়াশোনাটা কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে, চাকরি করতে হবে। আমি যা বেতন পাই তাতে ঢাকা শহরে সচ্ছলভাবে থাকাটা একটু কষ্টকর। স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে হলে, নিজের মতো চলতে হলে নিজের খুঁটি শক্ত হওয়াটা জরুরি। সেদিন আমি আবার ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। প্রথম প্রেমে পড়ি তার হাসি দেখে, শিম্পাঞ্জির মত হাসি নয়, মুচকি হাসির। আমার মায়ের ভীষণ দুঃখ তার ছেলে নাই। বাবা বলতেন, মেয়েদের পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ বানাও, ছেলেমেয়ে ব্যাপার না। নিজেরা নিজেদের দেখতে পারলেই হবে, আমাদের দেখতে হবে না। আমাদের দেখার জন্য আমরাই যথেষ্ট। বাবা তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। আমাদের দুইবোনকে শিক্ষিত করেছেন। এখন আমরা যে যে যার যার জায়গায় ভালো আছি, সুখে আছি। ছোটবোন চমৎকারভাবে বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন করছে। আমার বাবা সেই যুদ্ধের পরের সময়ের মাস্টার্স পাস। অথচ আজকালের বড় বড় পজিশনের অধিকারী স্যাররা ভাবেন, বড় বড় পদে বসার যোগ্যতা শুধুমাত্র পুরুষরাই রাখেন। তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো, মেয়েদের শান্তনা দেন।
মূলকথা হচ্ছে, যদি আমার বিয়েটা অস্ট্রেলিয়ার পাত্রের সাথে হয়ে যেত (শুনেছি অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক তার বউকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গিয়েছেন), আমি হয়তো “বিদেশে” যেতাম ঠিকই, কিন্তু আমার নিজস্ব কোন সত্ত্বা থাকতো না। বরের উপর নির্ভরশীল হতে হতো আর্থিক এবং মানসিকভাবে। বরের সাথে বরফ পানি খেলা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও নাই। অথচ আমি বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন অন্যভাবেও দেখতে পারতাম! এমন হাজার হাজার মেয়ে (বিবাহিত/অবিবাহিত/শিক্ষিত/অশিক্ষিত) আছেন, যারা খুব গর্ব করে বলেন, স্বামী হচ্ছে বটগাছের মতো, যে সারাজীবন ছায়া দিয়ে, বাতাস দিয়ে আগলে রাখে। কথাটা হওয়া উচিত ছিলো, স্বামী-স্ত্রী হলো বটগাছের মতো। কিন্তু এদের স্বামীই যদি আজকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলহীন হয়ে পড়েন, তবেই দেখা যাবে ভেলকি। কী ভেলকি জানেন, তখন এই বটগাছ সমতুল্য স্বামীই হয়ে যাবে অকর্মার ঢেঁকি কারণ সে নিজেও তাই। “এই প্রজাতি” নিজেদের বটগাছ বানানোর কথা কখনো ভাবেন না। কারণ পুরুষকে টাকা উপার্জনের মেশিন হিসেবে গণ্য করা হয় আমাদের সমাজে।
পরিবেশ পরিস্থিতি আসলে অনেকাংশে দায়ী আমাদের মানসিকতা গঠনে। যে মেয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয় সে কীভাবে বুঝবে স্বাধীনতার স্বাদ! যে মেয়ে ভাবে, সংসার মানে শুধু পুরুষ টাকা উপার্জন করবে, সে কীভাবে জানবে, মুক্তির কী স্বাদ! সংসার মানে “তুমি আমি আমরা”। সংসার হলো একটা টিমওয়ার্কের মতো। একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন কাজ করবে। আর এটা বোঝার জন্য শুধু সুশিক্ষিত হলে হবে না, স্ব-শিক্ষিত হতে হবে। আসুন, আমরা আমাদের সন্তানকে শেখাই কোন কাজই নির্দিষ্ট কারো জন্য নয়, সব কাজ সবার জন্য। শুধুমাত্র সামর্থ্য অনুযায়ী করতে হবে।