সময়ের সাথে সাথে পরীমণি কি সাহস আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠছেন?

সালমা লুনা:

এতোকাল ধরে শুধু নারীবিদ্বেষী চক্রটি সক্রিয় ছিল নারীকে উচিত অনুচিত শিক্ষা দিতে। পায়ে বেড়ি পরাতে। তারা পরীমণির বিরুদ্ধে সরব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার তাদের সাথে সবকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে যোগ দিয়েছে রাষ্ট্র স্বয়ং।

শুরু থেকেই পরীমণির পক্ষে অল্প কিছু সাধারণ মানুষ ছিল। যারা রাষ্ট্রের অন্তঃসারশূন্য চেহারা দেখে বীতশ্রদ্ধ , যাদের কোন লেজুড়বৃত্তি নাই সরকার বা কোন বিশেষ দলের সাথে, যারা নারীকে মানুষ ভাবে তারা এই অমানবিক, অগণতান্ত্রিক, নিষ্পেষণমুলক হয়রানিমুলক ঘটনার প্রতিবাদ করেছে নানাভাবে। আর এখন যখন পরিস্থিতি শাসকদলের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠতে চলেছে তখন শাসকদলের মিত্র বলে পরিচিতরাও সরব হয়ে উঠেছেন।

আফসোস, না বলে পারছি না তারা যদি সব বিষয়েই এমন হতেন তবে জনপ্রিয় হবার জন্য তাদের প্রিয় দলটির কখনও এর পিঠে চড়ে কখনও তার কাঁধে বসে জনগণের দৃষ্টি এদিক ওদিক সরানোর এতো কসরত হয়তো করতেই হতো না। অবশ্য তাদের মুখ খুলতেই হয়েছে। কারণ এই সভ্য জমানায় রাষ্ট্রের পুলিশ একজন নাগরিকের প্রতি যে অন্যায় করেছে, তাদের উগ্র উদাসীন চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে তাতে তাদের আর উপায়ও ছিলো না।

পরীমণি এখনও অভিযুক্ত। আসামী নয়।
এক্ষেত্রে অভিযুক্তের আইনী অধিকার লঙ্ঘিত করে, কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, মানবাধিকারকে কাঁচকলা দেখিয়ে নারীকে পদানত করতে সকল গভর্নিং বডি একত্রিত হয়ে মিত্রে পরিণত হয়েছে।
আর এই মিত্রজোট একটি আটাশ বছর বয়সী নাগরিকের উপর তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে তৎপর হয়ে উঠেছে।
নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের আক্রোশ মেটাতে উঠেপড়ে লেগেছে।
নারীবিদ্বেষী চক্র যাতে অভিযুক্ত মেয়েটির ব্যক্তিজীবনকে বারবার সামনে এনে মোরাল এথিকসের প্রশ্ন তুলতে পারে এজন্য তার ব্যক্তি জীবনকে প্রকাশ্যে এনে এ কাজে সহায়তা করেছে রাষ্ট্রের আইনের প্রতিষ্ঠানগুলো।

তারা জানতো নারীর জীবনাচরণের শুদ্ধতায় মোরাল এথিকসের মূলায় আকৃষ্ট জনগণের যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া যাবে এবং হয়েছেও তাই।
রাষ্ট্র যখন কাউকে পিষে ফেলতে ইচ্ছা করে তখন তাকে এমন কিছুই জনসমক্ষে আনতে হয় যা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে। আর এইজন্য মোরাল এথিকস আর চরিত্রহীন নারীর অপবাদ দেয়ার মতো বহু পুরনো শস্তা খেলা খেলতে হয়েছে! তার ব্যক্তিজীবনকে একদল হিংস্র হায়েনার সামনে এক টুকরো মাংসখণ্ডের মত ছুঁড়ে দিয়েছে। কালো টাকার মালিক, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী, ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী সকলেই এই খেলায় অংশ নিয়েছিল। তাদের উপযুক্ত প্রতিপক্ষ ছিল সুন্দরী মডেল অথবা অভিনেত্রী মেয়েটি।

গ্রেফতারের সময় লাইভে থাকা পরীমণির একটা কথা মনে পড়ে। সে খুব ছোট্ট করে বলেছিল, ‘মরলে একলা মরব না, সবাইকে নিয়েই মরবো’।
এর আগেও লাইভে চিৎকার করে বলেছে, ‘আমি মরবো না। যদি শোনেন আমি মরে গেছি, জানবেন আমি আত্মহত্যা করি নাই।’

মেয়েটি বুদ্ধিমতি।
সে জানতো এদেশে কী হয়। কী হতে পারে। নারীর সাথে কেমন আচরণ করা হয়। এসব জেনেই ক্ষমতাবান টাকাওয়ালাদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার স্বেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি।

এভাবে নারীকে প্রতিনিয়তই ব্যক্তিমানুষ,পরিবার, সমাজের বিপক্ষে দাঁড়াতে হচ্ছে নিজ প্রয়োজনেই।
সবাই পারে না।
পরীমনি পেরেছে।

নারী শাসক, শাসনতন্ত্রে নারীর পদায়ন হতে পারে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন এদেশে হয়নি।
বরং পরীমনি ঘটনায় পুরুষতন্ত্রের উপর ভর করা একটা রাষ্ট্রের নগ্ন স্বৈরাচারী চেহারা স্পষ্ট হয়েছে।
তাই এখন পরীমনি শাসককুল এবং তাদের মিত্রদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠতেই পারে।

যে নারী সাহস দেখায়, বিদ্রোহ করে, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করে, আপোষ না করে প্রলেতারিয়েতের অংশ হয়ে যায়। নিকট ও সুদূর ইতিহাস বলে, এইরকম বিদ্রোহী নারীর সংখ্যা হাতেগোনা।

সময় যত যাচ্ছে ক্রমশঃ সাহস আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠছে পরীমনি। এখন আর কারো পক্ষেই সহসা পরীমনিকে পাশ কাটানো যাবে না।

কেউ কেউ অতি আবেগে বলতে বাধ্য হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসের সাহসী ও বিদ্রোহী নারী প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, জোয়ান অব আর্কের কাতারে চলে এসেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের একজন সাধারণ রূপসী নারী, পরীমনি।

কথাটি খুব মিথ্যেও নয়।

দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে স্মরণকালে যে সমস্ত সুন্দরী মেধাবী নায়িকারা ছিলেন তারা অনেকে ব্যবহৃত হলেও রাষ্ট্র বা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কাউকেই করতে দেখা যায়নি।

সেক্ষেত্রে সময়ই বলে দেবে পরীমনি শুধু চলচ্চিত্র অঙ্গনের ইতিহাসে, নাকি দেশের ইতিহাসেও জায়গা পেতে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন: