পরীমণির ওপর দায় চাপানো প্রত্যেকেই একেকজন নাসির কিংবা আনভীর

সুমু হক:

আমাদের সমাজের তথাকথিত “শিক্ষিত”, “প্রগতিশীল” মানুষজনও যখন ইনিয়ে-বিনিয়ে ধর্ষকামিতার সংস্কৃতির পক্ষে সাফাই দেয় কিংবা বোঝানোর চেষ্টা করে, “ধর্ষণ অবশ্যই একটা অপরাধ, কিন্তু…” তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না আদতে এদের শিক্ষা আর প্রগতির দৌড় কতদূর।

বাংলাদেশের দোকানে বাজারে, মাছ বিক্রি করা কিশোর ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে উত্তর আমেরিকার পুলিশ বাহিনীর (বাঙালি) সদস্য, আমার মানসিকভাবে অপরিণত বোনের উন্নয়নকর্মী স্বামী থেকে শুরু করে অনলাইনে পরিচিত হওয়া তথাকথিত উচ্চমার্গের প্রগতিশীল ইন্টেলেকচুয়াল পুরুষ, কৈশোরে আমাকে আরবি পড়াতে আসা অশীতিপর বৃদ্ধ ওস্তাদজি থেকে শুরু করে টরন্টো শহরের বিখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব, কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে ইনস্টাগ্রামে পরিচিত হওয়া আমার হাঁটুর বয়সী কিশোর, এমন কোন সামাজিক অবস্থান, কোন বয়স, কোন পরিপ্রেক্ষিত থেকে আসা পুরুষ নেই, যার কাছ থেকে আমি কোন না কোনভাবে যৌন যৌন নিগ্রহের শিকার হইনি।
এর শুরু সেই আমার পাঁচ বছর বয়স থেকে (পাঁচ বছর বলছি কারণ সেইটুকু মনে আছে, তার আগেও ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা আমার স্মৃতিতে যেহেতু নেই, সেটা বলতেও পারছি না) এবং সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত পরশু।

পাঁচ বছর বয়সে আমি সাধারণ বাচ্চারা যা পরে, সেই ফ্রকই পরতাম, সেই ফ্রক পরেই নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানাতেই নিগৃহীত হয়েছিলাম, নিজেরই মামাতো বোনের স্বামীর হাতে, তাও আবার বাড়িভর্তি লোকজন থাকা সত্ত্বেও। মাছের বাজারের ঘটনাটি ঘটেছিল কোন এক শুক্রবার সকালে, বাবার সাথে ছবি আঁকার ক্লাস থেকে ফেরার সময় নিউমার্কেটের বাজারে ঢুকে। তখনও আমার বয়স ছয় হয়নি, কারণ সেটা হলিক্রসে ভর্তি হবার আগের কথা। আর গত পরশু যে হাঁটুর বয়সী ছেলেটি আমাকে ইনস্টাগ্রামে ইঙ্গিতপূর্ণ মেসেজ পাঠালো, সে আমাকে সামনাসামনি দেখা তো দূরের কথা, আমার খুব বেশি ছবিও দেখেনি!

তবুও এমন প্রশ্ন করতে তার একটুও বাঁধেনি। আমি ইনস্টাগ্রামে একাউন্টটি সদ্য খুলেছি। আমার এক অপেক্ষাকৃত তরুণ বন্ধু জানালো, ইনস্টাগ্রামের প্রোফাইলের নিজেকে আড়াল করার সুযোগ থাকায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াটা নাকি মেয়েদের জন্যে প্রায় ডালভাতের মতো ব্যাপার।
তো, এই যখন আমাদের সমাজের অবস্থা, তখন পরীমণির ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হবার জন্যে তার পোষাক কিংবা চরিত্রকে দোষ দেয়াটা কতখানি যৌক্তিক? তাছাড়া পরীমনি যদি নগ্ন হয়েও রাজপথ দিয়ে হেঁটে যান, তবুও তাকে ধর্ষণ করবার কোন অধিকার তো কারো নেই !
যদি তাই হতো, তাহলে আমাদের দেশের রাস্তার ধারে, যেখানে সেখানে প্যান্টের জিপার খুলে প্রস্রাব করতে দাঁড়িয়ে যাওয়া পুরুষগুলোর ধর্ষণের শিকার হওয়াটা সবার আগে যৌক্তিক হতো।
কিন্তু সেটা তো হয় না।

অথচ আমি কিংবা আমার কোন একটি বন্ধু কপালে একটি বড় টিপ পরার অপরাধে কিংবা মাথায় ঘোমটা না দেয়ার অপরাধে রাস্তায় প্রকাশ্যে যে কোন পুরুষের মুখ থেকে ছিঁটানো থুতু উপহার পেতেই পারি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে মসজিদের মাইক থেকে তারস্বরে অশ্লীল ভাষায় নারীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বর্ণনা এবং কি করে সেই সব প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুরুষকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, এবং কী করে সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকারিণী হওয়ার পাপে প্রত্যেকটি নারীকে অপরাধী গণ্য করে তাদেরকে তাদের জায়গামতো, অর্থাৎ পুরুষের পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখতে হবে, সেইসব নোংরা কথা শুনে শুনে প্রত্যেকটি নারীকে প্রতি মুহূর্তে হাজারবার মরতে হতেই পারে, কিংবা বোরখা, হিজাব-নিকাবের নিচে শরীরকে ঢেকেও, কেবলমাত্র পাবলিক বসে চড়ার অপরাধে একটি মেয়েকে শরীরে পুরুষের নোংরা স্পর্শ এমনকি ব্লেডের বিপদজনক আঘাতের ক্ষত ধারণ করতেই হবে। কেন? না, শুধুমাত্র সে একটি মেয়ে বলে।

ইন্টারনেট আর আকাশ সংস্কৃতির প্রাবল্যে পরীমণি যে সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই সংস্কৃতিকে সমর্থন করতে এবং একে ব্যবহার করতে, কিংবা এর পর্দায় ব্যবহৃত পরীমণির দেহটিকে ভোগ করতে আমাদের সমাজের পুরুষদের কোন আপত্তি নেই। এদের যত আপত্তি পরীমণিকে একজন রক্তমাংসের মানুষের মর্যাদা দিতেই। আর তাই বোধহয় পরীমণির নাসির ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আনা ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে এই সমাজের এতো মাথাব্যথা।

তাই বলছি শুনুন, পরীমণি কেন, ধরলাম এই আমি, আমি যদি একজন আপনাদের ভাষায় যাকে আপনারা “বেশ্যা” বলে সম্বোধন করে থাকেন তাই হতাম, যদি আমি মাঝরাত্তিরে নেশা করে শহরের মাঝখানে গড়াগড়ি খেতাম, যদি আমার শরীরে একটি সুতোও না থাকতো, তবুও আমাকে ধর্ষণ তো দূরের কথা, আমার স্পষ্ট মৌখিক অনুমতি ছাড়া আমাকে স্পর্শ করবার কোন অধিকার পর্যন্ত কারো নেই।
এমনকি সেই ধর্ষক যদি আমার কাগজে কলমে বিয়ে করা স্বামী হয়ে থাকে, তবুও।

কু-তার্কিকেরা বলবেন যে “বাংলাদেশের আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয় না”, সেক্ষেত্রে আমি বলবো, তেমনটা আমাদের দেশের আইনে নেই বলেই যে সেটা শুদ্ধ, তা তো নয়! আমাদের দেশে তো “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” বলেও একটি দারুণ আইন রয়েছে। আইন মাত্রেই যদি সমালোচনার ঊর্দ্ধে হতো, তাহলে আর এতো কাঠখড় পুড়িয়ে এই আইনটিকে পাল্টানোর জন্যে মাঠে নামার প্রয়োজন হতো না আমাদের!

ধর্ষণের কিংবা ধর্ষকের পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে কিংবা পরীমণির কাঁধে দোষ চাপাতে গিয়ে আপনারা এইটাই প্রমাণ করছেন যে সুযোগ পেলে পরীমণি কেন, যে কোন নারীর সামনেই দাঁত-নখ-থাবা বেরিয়ে পড়তো আপনাদের। সত্যিটা হলো আপনাদের কাছে কোন বয়সের কোন নারী, শিশু কিংবা অন্য কোন লিঙ্গের মানুষই নিরাপদ নন। আপনারা কারো বাবা, কারো স্বামী, কারো পুত্র, কারো ভাই, কিন্তু দিনশেষে আপনাদের একটাই পরিচয়, ভেতরে ভেতরে আপনারাও একেকজন নাসির কিংবা আনভীর। নেহায়েত সুযোগ পাচ্ছেন না বলেই দিব্যি ভালোমানুষের মুখোশ পরে বসে আছেন।

আপনারা কিছু বুঝবেন কিনা জানিনা, আমরা কিন্তু ঠিকই বুঝে নিয়েছি যা নেবার।
আপনাদের ভালোমানুষের মুখোশের পেছনে লুকিয়ে থাকা ধর্ষকের চেহারাগুলো ক্রমশঃ প্রকাশিত হয়ে পড়ছে।

শেয়ার করুন: