পরীমনি, হাহা রিয়াক্ট এবং ইন্ট্রা-ক্লাস কনফ্লিক্টে আপনার রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে?

দিলশানা পারুল:

সম্প্রতি চলচিত্র অভিনেত্রী পরীমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। রাত বারোটার দিকে তিনি উত্তরার একটি ক্লাবে যান, সেখানে তিনি ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদে দায়িত্বে থাকা নাসির মাহমুদ এবং তার সঙ্গী সাথী দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন র্নিযাতনের শিকার হন। এই ঘটনার পর পরীমনি অনেক সাহসিকতার কাজ করেছেন। তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা বয়ান এবং পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে তিনি চারদিন হলো বিভিন্ন জায়গায় বিচার দেয়ার জন্য ধন্না দিয়েছেন, উত্তরা থানা, বনানী থানায় মামলা দিতে চেয়েছেন, কিন্তু কোন থানায় তার মামলা নেয়া হয়নি। তিনি চলচ্চিত্র সমিতিতে বিচার দিতে চেয়েছেন, কিন্তু সবাই তাকে চেপে যেতে বলেছেন।

পরীমনি তার ফেইসবুক পেইজে প্রধানমন্ত্রীকে নয়বার ‘মা’ বলে সম্বোধরন করে তার উপর হওয়া এই জুলুমের বিচার চেয়ে পোস্ট দিয়েছেন, এবং তারপর আমরা জানতে পেরেছি। যে পোস্টটিতে তিনি তার উপর হওয়া জুলুমের কথা বলেছেন সেই একই পোস্টে ৬৫ হাজার হাহা রিয়াক্ট। মানে বিরাট একটা অংশের নাগরিকের কাছে এইটা হাস্যকর মনে হয়েছে। কিন্তু কেন? বিরাট একটা অংশের মানুষ পরীমনির উপর হওয়া এই ঘটনার পিছনে এমপ্যাথেটিক না। প্রশ্ন হচ্ছে কেন?

প্রথম দেখি এই হাহা রিয়াক্ট আসলে কারা দিলো। আমার অবজারভেশন বলে পরীমনি তার লেখায় প্রধানমন্ত্রীকে নয়বার মা বলায় রাজনীতিকে যারা সরল ভাষায় দেখেন এবং বোঝেন, তাদের কাছে এইটা সাথে সাথে আওয়ামীপন্থী হয়ে গেছে, একদল আর কোনকিছু দেখার বা বোঝার প্রয়োজন বোধ করেননি। নিজেদের আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি করি মনে করে তারা এই পোস্টে হাহা রিয়াক্ট দিয়ে দিয়েছেন।

আরেক দল আছেন যারা মনে করেন বিনোদন জগতের নারী মানেই যৌনকর্মী, এদের তো যেকোন জায়গায় যেকোনভাবেই ব্যবহার করা যায়। সেইখানে পরীমনির উপর নিপীড়নের এই ধরনের অভিযোগ করা খুবই হাস্যকর বিষয়, তারাও হাহা রিয়াক্ট দিয়েছেন।

আরেকটা সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না, ফেইক প্রোফাইল, মার্কেটিং আইডি দিয়ে ঘটনার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়ার জন্য, পরীমনির প্রতি মানুষের এমপ্যাথি কমিয়ে দেয়ার জন্য এইটা করা হতে পারে। তবে এইটা একদমই কন্সপিরেসি থিউরি।

আমি প্রথম গ্রুপ নিয়ে আলোচনাটা করতে চাই। মানে রাজনৈতিকভাবে যারা, নিপীড়নের শিকার পরীমনিকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন সেই অংশটাকে নিয়ে। খেয়াল করেন পরীমনি কিন্তু প্রথমেই মা বলে ফেইসবুকে পোস্ট দেননি। তিনি চারদিন দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরেছেন এবং কোথাও কোন সহযোগিতা পাননি, বরং তিনি দেখেছেন সবাই তাকে নিরুৎসাহিত করছেন এবং বিচার পাওয়ার আশা তার নাই। তার সাথে যুক্ত হয়েছে মৃত্যু ভয়।

এখন তার মৃত্যু ভয়টা কি অমূলক? না, কারণ মুনিয়ার হত্যা বা আত্মহত্যাই বলে দেয় এই ধরনের ক্ষমতাশালীদের বলয়ে পড়লে, তাদের কথামতো না চললে বেঁচে ফিরে আসা কঠিন। এবং হত্যা, আত্মহত্যা অস্বাভাবিক কিছু না। আরেও আগে নায়িকা/মডেল তিন্নীকে হত্যার ঘটনা আমরা দেখেছি। এখনও পিছনের কোন কারণ কেউ বের করতে পারেনি, মূলত চায়নি কেউ বের করতে। সেই জায়গা থেকে এই রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। আপনি আপনার রাজনীতি বুঝলেন, কিন্তু ব্যক্তি নারী হিসেবে পরীমনির অসহায়ত্ব বোঝার ক্ষমতা আপনার নাই। পরীমনির যে স্টেটমেন্ট, সেটা প্রায় অচল একটা বিচার ব্যবস্থাসম্বলিত রাষ্ট্রে নিপীড়নের শিকার অসহায় একটা নারীর বক্তব্যের বাইরে আর কিছু না।

আরেকটা অংশ পরীমনির জন্য ভয়েজ রেইজ করাটাকে সুশীলের রাজনীতি বলে চিহ্নিত করছেন। এবং তারা মনে করছেন পরীমনির জন্য যারা আওয়াজ তুলবেন বা তুলেছেন, তারা উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই বেশি হওয়া কথা। এবং সেইটাই ঠিক। কিন্তু তাতে সমস্যা কী? তাইলে কি দাঁড়াচ্ছে যে শুধু গরিব ঘরের মেয়ে নির্যাতনের শিকার হইলে সেইটা নির্যাতন? মধ্যবিত্ত এবং বড়লোক ঘরের মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হইলে সেইটা নির্যাতন না? সেইটা নিয়ে কথা বলা যাবে না? বিষয়টা কি এমন গরিবের মেয়ে ধর্ষণ এর শিকার হইলে সেইটা বড় অপরাধ, আর ধনীর মেয়ে ধর্ষণের শিকার হইলে সেইটা ছোট অপরাধ? ধর্ষণ তো ধর্ষণই। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ওজন হিসেবে দুইটার মাত্রা একই। এখন তুলনামুলকভাবে সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রিভিলেজড অবস্থানে যে ভিকটিম থাকবে হয়তো সে তার সামাজিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তার বিচার পাওয়াটাকে খানিকটা প্রভাবিত করতে পারে, আর গরিব ঘরে থাকলে তার বিচার পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। তাইলে এখন আপনি আমি করবো? গরিব শ্রেণিতে যেহেতু বিচার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই ওই জন্য যেই শ্রেণিতে নুন্যতম সম্ভাবনা আছে, সেইটাকেও হেয় করবো? আমরা কোনটা বলবো আসলে? যে গরিব যখন বিচার পায না তখন কেউ বিচার পাবে না এইটা? না সবাই যেন বিচার পায় সেইটা?

শ্রেণি সংস্কৃতির প্রতি সমশ্রেণির বিলংগিংনেস থাকবেই, এইটাই স্বাভাবিক। পাশের বাসার ভাবী যৌন নিপীড়নের শিকার হলে সেইটা যেমন এই বাসার ভাবীকে নাড়া দিবে, একইভাবে আগারগাঁও বস্তিতে ধর্ষণের শিকার হলে দিবে না, দেয় না। একইভাবে একই গার্মেন্ট শ্রমিক একটা মেয়ে তার সহকর্মীর নির্যাতন যেইভাবে ফিল করবে, অপর শ্রেণির নির্যাতন একইভাবে ফিল করবে না। শ্রেণি সংস্কৃতি এবং বিলংগিংনেস খুব সচেতন চর্চ্চা ছাড়া উৎরানো যায় না। এইটা সীমাবদ্ধতা, কিন্তু খুব স্বাভাবিক বিষয়। এইটা অপরাধ না। যে যার নিজের শ্রেণিতে ঘটে যাওয়া জুলুম নিয়েও যদি সোচ্চার হয়, তাতে তো অপর শ্রেণির রাগ করার কিছু নাই। এই প্রতিবাদ কামপার্টমেন্টাল প্রতিবাদ খুবই ঠিক, কিন্তু কামপার্টমেন্টাল বলে এইটাকে খারিজ করার তো কোন সুযোগ নাই। বরং যে যেইখানে যেভাবে পারে, সব ধরনের জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকাই সমাধান।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুর্নিদিষ্টভাবে পরীমনির ঘটনা তো বড়লোকের অভ্যন্তরীন কোন্দল। আপনি তাইলে কোন পক্ষ নিবেন? নিজেরে প্রশ্ন করেন এইখানে কি জুলুমের ঘটনা, নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাইলে আপনার জন্য পক্ষ নেয়া সহজ। আর যেইদিকে যান নিপীড়কের পক্ষ নিয়েন না। জুলুমবাজের পক্ষ নিয়েন না। শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ র্নিবিশেষে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারলে, নিপীড়কের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারলে নিপীড়নবিরোধী কোন সংস্কৃতি দাঁড় করাতে পারবেন না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.