‘বুড়িমার হাসপাতাল’ এর অদম্য ‘বুড়িমা’ সুভাষিণী মিস্ত্রী

উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক:

সমাজে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন সুভাষিণী মিস্ত্রী। যাঁকে বলা হয়, ‘one-woman army’। জীবনের ৪৫টা বছর ধরে লড়াই করে বিন্দু থেকে সিন্ধু গড়ে তুলেছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল, যার নাম “Humanity Hospital“। যেখানে তাদের চিকিৎসাই করা হয় যাদের কোন সামর্থ্য নাই অন্য হাসপাতালে যাওয়ার। এর পিছনের গল্পটি চমকপ্রদ এবং কষ্টদায়কও।

আজকের ৭১ বছর বয়সী সুভাষিণীর স্বামী বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন যখন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। চার-চারটি বাচ্চার মা ততদিনে। দিনশেষে মুখে এক লকমা ভাত তুলে দেয়ার প্রাণপণ লড়াইয়ে সেদিন নেমেছিলেন তিনি। তাঁর স্বামী সাধন চন্দ্র মিস্ত্রী ছিলেন একজন কৃষক। ধানক্ষেতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন একদিন। প্রচণ্ড ডায়রিয়া নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ডাক্তার এবং নার্সরা, কারণ তারা সমাজে নিম্নবিত্ত। মারা যান সাধন চন্দ্র।

সুভাষিণী এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন, “স্বামীর মৃত্যুর পর স্বভাবতই আমি ভেঙে পড়েছিলাম, কিন্তু ঘরে ছিল চারটি অনাহারি মুখ। আমার কোন শিক্ষা নেই, এমনকি ঘড়ি দেখতেও জানতাম না আমি। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেই যে কাজই পাই না কেন, করবো”। মানুষের বাড়িতে তিনি কাজ করেছেন, দিনমজুর হিসেবে কাজ করেছেন, সব্জি বিক্রি করেছেন, কেবলমাত্র চারটা সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু মাথায় ছিল অন্য একটা স্বপ্ন। একটু একটু করে টাকা জমাতে থাকেন তিনি। একদিন এক বিঘা জমি কেনার সামর্থ্য হয় তাঁর। নিজেই সেখানে মাটি কেটে ভরাট করা শুরু করলে এগিয়ে আসে গ্রামের লোকজন। শুরুতে তাঁকে সবাই ‘পাগল’ ঠাওড়ালেও একসময় সেই পাগলামিতেই সবাই সায় দেন। এগিয়ে আসেন, ১৯৯৩ সালে গড়ে তোলেন হিউম্যানিটি ট্রাস্ট এবং একটি অস্থায়ী ক্লিনিক গড়ে তোলেন সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য। ১৯৯৬ সালে সেই অস্থায়ী ঘরটিই স্থায়ী ভবন হয়ে উঠে। সারাজীবনের সঞ্চয় আর পরিশ্রমের ফসল কলকাতার হাঁসপুকুর গ্রামের এই হিউম্যানিটি হাসপাতালের নাম একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ততদিনে। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর সেই ভবনটি উদ্বোধন করেন।

সুভাষিণীর স্বপ্ন এখানেই শেষ হয় না। তাঁর হাসপাতাল চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেমেয়ের একজনও যেন অন্তত এই হাসপাতালের চিকিৎসক হয়। সেটিও হয়েছে। হাসপাতালটির চিকিৎসকদের একজন অজয়, সুভাষিণীর সন্তান, যে কিনা মায়ের স্বপ্নকেও সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধদপরিকর। শুধু পদ্মশ্রীই নয়, সুভাষিণীর থলেতে জমা হয় আরও অনেক পুরস্কার। ২০০৯ সালে গডফ্রে ফিলিপস ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ড তার একটি।

চলুন আরও কিছু কথা শুনে আসি প্রিয়া সেনের কাছ থেকে।

প্রিয়া সেন লিখেছেন,
কলকাতার কপোর্রেট হাসপাতালগুলির কর্তাদের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ৭৩ বছরের বৃদ্ধা, শ্রীমতী সুভাষিণী মিস্ত্রী।
তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমি পারলে আপনারা পারবেন না কেন?’’

স্রেফ কথার কথা নয়, কীভাবে কম খরচে মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায় তা পরখ করতে রাজ্যের কর্পোরেট হাসপাতালগুলির কর্তাদের নিজের হাসপাতালে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বৃদ্ধা। তাঁর দাবি, ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় যে হয় তা আমি ওঁদের দেখাতে চাই। মানুষের পাশে দাঁড়ালে আশীর্বাদ পাবেন।’
ঠাকুরপুকুর বাজার লাগোয়া হাঁসপুকুরে হাসপাতাল বুড়িমার হাসপাতালে না-গেলে বোঝাই যেত না কীসের জোরে তিনি এই ভাবে তিনি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন কর্পোরেট হাসপাতালকে।

১৯ কাঠা জমির উপর ৪৫ শয্যার হাসপাতাল। ২০ জন ডাক্তার (এর মধ্যে স্থায়ী-বেতনভুক ৪ জন, বাকিরা টাকা না-নিয়ে চিকিৎসা করেন), ৩২ জন নার্স। গরীব রোগীদের এক টাকাও লাগে না সেখানে চিকিৎসার জন্য। বিনা পয়সায় তাঁরা পান ওষুধ। ১০ শয্যার আইসিসিইউ। নিখরচায় ভেন্টিলেশন। আউটডোর ছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, আই, ইএনটি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক, ইউরোলজি-সহ একাধিক বিভাগ চলে এখানে। অস্ত্রোপচার হয়। হয় প্রায় সবরকম পরীক্ষা।
নাম ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’ হলেও লোকমুখে পরিচিতি ‘বুড়িমার হাসপাতাল’ নামেই।

বছর কুড়ি আগেও সুভাষিণী মিস্ত্রিকে এলাকার মানুষ চিনতেন ‘সব্জি মাসি’ বলে। তিনিই এখন হাসপুকুরের ‘হাসপাতাল দিদিমা’! কীভাবে সম্ভব হলো এই পরিবর্তন? আনাজ বিক্রেতা এক সামান্যা নারী কীভাবে তৈরি করলেন একটা হাসপাতাল? এতো টাকাই বা পেলেন কোথা থেকে?

কাহিনী সিনেমার গল্পের মতো।
প্রতিবেশী এক প্রবীণ অধ্যাপক বললেন, ‘লোকের বাড়ি কাজ করা দিয়ে ওঁর যুদ্ধ শুরু। লোকের এঁটো খেতেন। বাচ্চাদের নিয়ে ধাপার মাঠে ময়লা ঘেঁটে কয়লা তুলে বিক্রি করতেন। সবশেষে চৌবাগা থেকে ভোর তিনটেয় ঠেলাগাড়িতে আনাজ তুলে কোলের বাচ্চাটাকে তার উপর বসিয়ে ঠেলে চার নম্বর ব্রিজের তলার বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন।’’ বাকি ছেলেমেয়েদের দিয়েছিলেন অনাথ আশ্রমে।

সরশুনার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসক রঘুপতি চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘প্রথম যেদিন পাড়ার লোকেদের ডেকে হাসপাতাল করবেন বলে উনি জানালেন, আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি। যে দিন দেখলাম ধান জমিতে কোমর জল ঠেলে মাথায় করে মাটি নিয়ে ফেলছেন তখন আমরা ভাবতে শুরু করলাম কিছু একটা করবেন উনি।’ তাঁর কথায়, ‘তখনই আশপাশের মানুষ, গ্রামপ্রধান সবাই এককাট্টা হয়ে তৈরি করলেন ট্রাস্ট। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি হলো। সবাই টাকা দিল। এতো কাদা ছিল যে, বাঁশের রণপা পরে হাসপাতাল তৈরির কাজ তদারকি করতে যেতাম আমরা। সেটা নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কথা। প্রথমে তৈরি হল আটচালা, পরে এই বাড়ি,’— বলছিলেন প্রবীণ চিকিৎসক।

এখন আধময়লা শাড়ির ঘোমটাটা মাথায় টেনে বুড়িমা ঘুরে বেড়ান হাসপাতালের প্রতিটি ঘরে, রোগীদের কাছে। ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, ‘‘সবাই বলেছিল, মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যে কাছের লোককে হারিয়েছে সে জ্বালাটা জানে। জেদ ছিল, যেন আমার স্বামীর মতো কাউকে মরতে না-হয়। ভাল কাজে ঠিক লোক আর টাকা জুটে যায়।’’

সমস্ত অপ্রাপ্তি সত্ত্বেও সুভাষিণী মাথাটা তাঁর উঁচুতেই তুলে রাখতে চেয়েছেন বরাবর, এবং তা পেরেছেনও। অদম্য এক নারী এই সুভাষিণী, যিনি কিনা সত্যিকার অর্থেই ভারতের আসল তারকা। মানুষ মূলত বিশ্বাস করে যে বিশ্বাস অটুট রেখে কোন কাজ করলে সেই কাজটা একদিন প্রতিষ্ঠা পাবেই। সুভাষিণী তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। তিনি নিজের পুরোটা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে।
উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে তাঁর এই লড়াই, স্বপ্নের পিছনে তাঁর অদম্য ছুটে চলাকে স্যালুট জানাই আমরা।

শেয়ার করুন: