বৈবাহিক ধর্ষণ বন্ধের জন্য বন্ধুত্বের বিকল্প নেই

আলী আদনান:

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে নানান ধরনের সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। চর্চা করতে হয়। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক কোনটি? আমার দৃষ্টিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক নারী- পুরুষের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব যদি নির্দিষ্ট একটা কমিটমেন্টে আসে তাহলে সেটা প্রেম, আর যদি লিখিত একটা সামাজিক চুক্তিতে আসে, তাহলে সেটা বিয়ে। নারী পুরুষের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের জন্য প্রথম শর্ত বন্ধুত্ব।

নারী পুরুষের সম্পর্ক প্রেম বা বিয়ে যাই হোক না কেন- সেখানে ‘বন্ধুত্ব’ সবচেয়ে বড় শর্ত। তরুণ – তরুণীরা প্রেম করুক। সবার জীবনে প্রেম আসুক। তবে তার ভিত্তিটা নির্মিত হোক বন্ধুত্ব দিয়ে। বিয়ে করতে হলে করুক। তবে তার আগে এ প্রশ্নটা উঠুক, যে দু’জন নর-নারীর বিয়ে হচ্ছে, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়া কতোটুকু।

আমাদের দেশের মেয়েরা হতভাগা৷ আমাদের অনেক মেয়ে বিয়ের আগে নিজের শরীরটাও ভালো করে দেখার সুযোগ পায় না। সে মেয়েই বিয়ের দিন রাতে হুট করে একজন অপরিচিত লোকের সামনে কথাবার্তা ছাড়া নগ্ন হতে হয়৷ পারিবারিকভাবে অপরিচিত নারী-পুরুষের মধ্যে যেসব বিয়ে হয়, সেসব বিয়ের ক্ষেত্রে কয়জন নারী আছেন এদেশে যাদেরকে বিয়ের প্রথম রাতেই নগ্ন হতে হয় না? বা প্রথম রাতেই যৌন অভিজ্ঞতা হয় না এমন দম্পতির সংখ্যা কেমন? জরিপে যে সংখ্যাটা বেরিয়ে আসবে তা নিতান্তই হাস্যকর।

‘বাসর রাত’ শব্দটা আমাদের সাহিত্যে, সমাজে, নানা আলোচনায় যতো মধুমিশ্রিত করে শোনানো হয়, এটা সত্যিকার অর্থে আদৌ এমন মধুর শব্দ নয়। অনেক নারীর জন্য বাসর রাত একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার রাত। অনেকের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি বুঝেছি, অনেক নারী সারাজীবন বাসর রাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়ান৷ তারা বছরের পর বছর এক ছাদের নিচে বিবাহিত সম্পর্কে স্বামীর সাথে বসবাস করেন ঠিকই। দু’তিন জন সন্তানের মা হন বটেই। কিন্তু নারী পুরুষের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের যে আনন্দ তা কখনোই তারা পান না।

প্রথম রাতেই যে ভয় বা তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের হয় অবচেতন মনে সেই ভয় লুকিয়ে থাকে। কেউ কেউ ভয়কে জয় করতে পারলেও নানা কারণে অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। আমার উপলব্ধি হচ্ছে এদেশে অনেক নারী সারাজীবনেও একটা আনন্দময় যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করেন না। ‘যৌন অভিজ্ঞতা’ আর ‘আনন্দময় যৌন অভিজ্ঞতা’ দুটো কখনোই এক কথা নয়।

ইদানিং একটা আওয়াজ খুব জোরালো হচ্ছে। ‘ম্যারিটাল রেপ’ বা বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে অনেক নারী সোচ্চার হচ্ছেন। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি ও কুযুক্তি আমরা শুনছি। ম্যারিটাল রেপ ব্যাপারটা তো মিথ্যা নয়। কেন ম্যারিটাল রেপ হয়, এর কারণ কী, প্রতিকার কী, করণীয় কী- অনেক কথা অনেকেই বলছেন। আবার অনেকেই এমন আলাপকে ‘অশোভনীয়’ বলে কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। মূলতা যারা এড়িয়ে যাচ্ছেন তারা সচেতন বা অসচেতনভাবে ম্যারিটাল রেপিস্ট। মাত্র এক প্রজন্ম আগেও তাদের পূর্বপুরুষরা বাসর রাতে বিছানায় রক্তের দাগ দেখতে চাইতো। এখনও কোন কোন এলাকায় বা পরিবারে তা দেখে বলে শোনা যায়।

লেখার শুরুতেই বলেছি, নারী পুরুষের বন্ধুত্বের বিকল্প নেই৷ ম্যারিটাল রেপ বন্ধ হওয়ার জন্যও নারী পুরুষের বন্ধুত্ব দরকার। দু’জন নারী ও পুরুষ- তাদের মধ্যে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে এবং তারা বিয়ে করে, তাহলে বিয়ের পর ম্যারিটাল রেপ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। একটা মান্ধাতার আমলের চিন্তা আমাদের সমাজে প্রবল। সমাজ চায় বিয়ের পর স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব হোক। এটা কেমন কথা?

মন্ত্র পড়ার পর বা কবুল বলার পর হুট করে একজন অপরিচিত নারী অপরিচিত পুরুষকে বা অপরিচিত পুরুষ অপরিচিত নারীকে বন্ধু বানাবে- এটা কীভাবে সম্ভব? বন্ধুত্ব কী এতো সহজ? দু’জন অপরিচিত নারী পুরুষকে কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর একটা রুমে ঢুকিয়ে দিল, কিছুক্ষণ পর পুরুষটি নারীটির উপর তার পাশবিকতা চর্চা করল এবং পরদিন থেকে তারা বন্ধু হয়ে গেল- এটা কী বায়বীয় প্রত্যাশা নয়? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা ছোটবেলা থেকে এটাই শিখে বড় হয়, নারীর উপর যে পুরুষ যতো বেশি শক্তি প্রদর্শন করতে পারে সে ততো বেশী ‘পৌরুষত্ব’ রাখে। ‘পৌরুষত্ব’ ও ‘নারীত্ব’ এ শব্দগুলো যে সমাজে এত প্রাধান্য পায় সে সমাজে ম্যারিটাল রেপ বন্ধ করা কঠিন।

অনেকে কথায় কথায় যুক্তি দেখান, আমাদের মায়েদের আমলে, আমাদের দাদীদের আমলে কি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল না? আমি বলছি, ছিল না। আমার মা কখনোই আমার বাবার বন্ধু ছিলেন না। চিরকালই আমার মা আমার বাবার সামনে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন। স্কুলের কড়া হেডমাস্টারকে আমরা ছোটবেলায় যেমন ভয় পেতাম, আমার মা আমার বাবাকে তার চেয়েও বেশি ভয় পেতেন। এখানে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটা হাস্যকর। হ্যাঁ, সামাজিক কারণে আমার বাবা মায়ের ভরণপোষণ পুরোপুরি চালাতেন। সেখানে বন্ধুত্ব নেই। সেটা নিতান্তই ‘দায়বদ্ধতা’। তারা স্বামী স্ত্রী ছিলেন বটে, কিন্তু কখনোই বন্ধু ছিলেন না।

আমার নানীর বিয়ে হয়েছিল বারো বছর বয়সে। উনি কখনো দিনের বেলায় নানার রুমে যেতেন না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে তারপর যেতেন। হ্যাঁ, সমাজ তাদেরকে সুখী দম্পতি বলতো। কিন্তু আমি কী বলবো, তারা বন্ধু ছিল? বন্ধু থাকলে নিশ্চয় তার বয়স পঁয়ত্রিশ হওয়ার আগেই তিনি দশজন সন্তানের মা হতে পারতেন না। তারাও স্বামী স্ত্রী ছিলেন, কিন্তু বন্ধু ছিলেন না। সকল বন্ধু যেমন স্বামী স্ত্রী নয়, তেমনি সকল স্বামী স্ত্রীও বন্ধু নয়।
স্বামী যতোক্ষণ পর্যন্ত বন্ধু না হয়ে ‘স্বামী’ থেকে যায়, ততোক্ষণ পর্যন্ত ম্যারিটাল রেপ বন্ধ হবে না।

তাই নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হোক। সেই বন্ধুত্ব যদি ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছায়, দু’জনের যদি পারস্পরিক সম্মতি থাকে, তবেই তা শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় রূপ পাক। আর যদি সেই বন্ধুত্ব বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় তাহলে তো আরো ভাল।

আরেকটা বিষয় আমরা ইদানিং খেয়াল করি। সেটা হলো বিয়ের আগে মেয়েকে মেয়ের পরিবার জিজ্ঞেস করে তার পছন্দের কেউ আছে কিনা। যে সমাজে স্কুল-কলেজে ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব নিয়ে বাঁকা টিপ্পনি কাটে, সে সমাজেই মেয়েদের বিয়ের আগে অনেক পরিবারে প্রশ্ন করে পছন্দের কেউ আছে কিনা। এটা একটা সুবিধাবাদী আচরণ।
মেয়ে বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তার জীবনে প্রেম আসি আসি করছে। বা প্রেম হয়তো তাকে ঘিরে রেখেছে। অভিভাবকরা এটা দেখেন। আগে যেরকম এর বিরুদ্ধে হম্বি তম্বি করতেন, এখন সেরকম করেন না। নীরব প্রশ্রয় দেন। কেন প্রশ্রয় দেন? আপনি কী ভেবেছেন, সমাজ নারী পুরুষের বন্ধুত্ব বা প্রেমকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে, বা মেয়ের মতামতকে মূল্যায়ন করছে- সেজন্য পরিবার মেয়ের প্রেমকে প্রশ্রয় দিচ্ছে? মোটেই না।

আমাদের সমাজে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতামাতা একটা মানসিক চাপে থাকেন। পুঁজিবাদের চরম প্রভাব বিয়েতেও পড়েছে। অনেক পরিবারের জন্য বিয়ে একটা বড় বোঝা। যে বোঝার ভার বইতে অক্ষম হলেও বইতে হচ্ছে। মেয়ের মা যখন জানেন মেয়ের সাথে কোন ছেলের প্রেম হয়েছে বা একটু ভালো লাগালাগি চলছে, মেয়ের মা তখন একটু খোঁজখবর নিয়ে তাতে নীরব সম্মতি দেন। তিনি ভাবেন, এটাও বিয়ের একটা বড় সুযোগ। এমন বিয়েতে যৌতুকের চাপ থাকবে না বা চাপ কম থাকবে, পাত্র পক্ষ কঠিন দরকষাকষি করবে না বা করলেও কম করবে।

আমি মনে করি, এমন বিয়েগুলোতেও নারী পুরুষের বন্ধুত্ব পুরোপুরি হয় না। একটুখানি ভাললাগা আর ‘বন্ধুত্ব’ হওয়া কখনোই এককথা নয়। নিজের পছন্দে বিয়ে করা আর বন্ধুকে বিয়ে করা কখনোই এককথা না। এক্ষেত্রে মেয়েটি নিজের পছন্দের পাত্রকে হয়তো বিয়ে করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু পাত্র তার বন্ধু কিনা বা তাদের মধ্যে কতোটুকু বন্ধুত্ব হয়েছে- সে তর্ক থেকেই যাচ্ছে। এমন অপরিণত বা মোহ আক্রান্ত সম্পর্কগুলো যখন বিয়েতে গড়ায়, তখনও সেখানে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে না। অন্য সকল বিয়ের মতো এখানে পুরুষটি তার ‘পুরুষতান্ত্রিক’ মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। বিয়ের আগে মেয়েটি যে স্বপ্ন দেখে, তার মধ্যে যে আবেগ, কৌতুহল কাজ করে, বিয়ের পর কিছুদিনের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও মেয়েটি প্রায়ই ম্যারিটাল রেপ- এর শিকার হয়।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মেয়েদের জীবনে কী তাহলে প্রেম আসবে না। আসবে। কিন্তু প্রেম আসলেই যৌনসম্পর্ক হবে কি হবে না বা প্রেমটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে কী গড়াবে না তার জন্য উভয়কে যথেষ্ট বোঝাপড়ার সময় দেওয়া প্রয়োজন। ভালোলাগা আর ভালোবাসা যে এককথা নয় তা বোঝার আগেই সমাজ দুটো ছেলেমেয়েকে বিয়ের মুখোমুখি করে। যার ফলাফল এই ম্যারিটাল রেপ।

আবারও ঘুরে-ফিরে নারী-পুরুষের বন্ধুত্বে আসছি।
আমাদের জীবনে বন্ধু আসুক৷ নারীর জীবনে পুরুষ বন্ধু আসুক। পুরুষের জীবনে নারী বন্ধু আসুক। মেলামেশা হোক। আড্ডা হোক। চিন্তাভাবনাগুলো পারস্পরিক বিনিময় হোক। একে অপরের ভাললাগা, মন্দলাগা বুঝুক। কার রুচিবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা অবশ্যই বিয়ের আগে জানা দরকার। সম্পর্কের প্রতি কার সম্মান কতোটুকু, যত্ন কতোটুকু তা বোঝার জন্য সময় নেওয়া হোক। প্রথম ভালো লাগাতেই বা ভালবাসাতেই বিয়ে হতে হবে – এমন কোন আইন কোথাও পাস হয়নি। আজ যাকে ভালো লাগছে, কাল তাকে ভালো নাও লাগতে পারে। একজন মানুষের সবকিছু অন্যজনের পছন্দ নাও হতে পারে। প্রত্যেকের চরিত্রেই কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। এগুলো বোঝার জন্য আড্ডা, শেয়ারিং, মেলামেলার বিকল্প নেই।
উভয়ের সবকিছু উভয়ের পছন্দ হলে তবেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

বিয়ের পরে যৌনসম্পর্ক নিয়ে স্বামী স্ত্রী নিজেদের মধ্যে কথা বলা দরকার। কার কেমন পছন্দ, কখন পছন্দ, কীভাবে পছন্দ- এসব নিয়ে যতো কথা হবে, স্বামী স্ত্রী উভয়ের কাছে যৌনতা ততোই আনন্দময় হবে। লুকোচুরি করলে বা লজ্জা পেয়ে এড়িয়ে গেলে সমস্যা বাড়তেই থাকবে। সর্বোপরি স্বামী – স্ত্রী একে অপরের ভালো বন্ধু, একথা শুধু কাগজে কলমে না রেখে আমাদের চিন্তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ‘মেরিট্যাল রেপ’ শব্দটা সমাজ থেকে মুছে ফেলা সম্ভব।

(লেখক: আলী আদনান, লেখক, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট। মেইল: [email protected])

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.