সারওয়ার-ই আলম:
পোশাক-আশাকের জন্য আমাদের দেশে এবং দেশের বাইরে প্রবাসী কমিউনিটিতে কোন কোন বাঙালি নারীকে বিভিন্ন সময় তীর্যক সমালোচনার শিকার হতে হয়। সমালোচনাগুলো অধিকাংশ সময় পুরুষদের কাছ থেকে আসলেও অনেক নারীও এ ধরনের সমালোচনায় অংশ নেন। এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তাহলো— ‘অশ্লীল পোশাক’। অশালীন বোঝাতেই এই অশ্লীল শব্দের ব্যবহার।
প্রশ্ন হলো একজন নারীর কোন পোশাকটি শালীন আর কোন পোশাকটি অশালীন এটা নির্ধারণ করা হবে কীভাবে? একজন নারী জানবেন কীভাবে— তিনি খুব পছন্দ করে যে পোশাকটি পরছেন, সমাজের কাছে তা শালীন না অশালীন পোশাক হিসেবে বিবেচিত হবে?
আমাদের দাদী-নানী, মা-চাচীরা বাড়িতে শাড়ি পরতেন এবং এখনো পরেন। সাধারণত শাড়ির সঙ্গে পরা হয় কনুই পর্যন্ত ব্লাউজ। এতে তাদের কনুই থেকে হাতের কব্জি পর্যন্ত দেখা যেতো। পোশাকের এই ধারাটি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এটি বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। দেশে এবং প্রবাসে এভাবেই বাঙালি নারীরা শাড়ি পরিধান করেন। প্রশ্ন হলো এভাবে শাড়ি পরাটাকে কি আমরা অশালীন পোশাক বলবো?
গরমকালে রান্না করার সময় কেউ কেউ প্রচণ্ড তাপে অসহ্য হয়ে ব্লাউজও পরেন না। কাজে কর্মের ব্যস্ততার কারণে তাদের বাহু উন্মুক্ত হয়ে যায়। ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরাটাকে আমরা কি অশালীন পোশাক বলতে পারি?
অবিবাহিত নারীরা সাধারণত সালোয়ার কামিজ বেশি পরতেন এবং এখনও পরেন। কামিজের উপরে একটা ওড়না পরা হয়। ওড়না কামিজের সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে আটকে থাকে না। অবচেতনে, অসাবধানতায় বাতাসে সরে যায়। ফলে তাদের শরীরের আকৃতি দৃশ্যমান হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কামিজ অতিরিক্ত আঁটসাঁট হলে কারো কোমরের আকৃতিও বোঝা যায়। গ্রাম ও শহরে এটাই বাস্তবতা। এখানে কি আমরা সালোয়ার-কামিজকেও অশালীন পোশাক হিসেবে আখ্যায়িত করবো?
ঢাকায় নাগরিক জীবনে, দোকানপাটে কেনাকাটার সময় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দেখেছি আমাদের নারীরা যখন শাড়ী পরতেন তখন তাদের কারো কারো পেটের কিয়দংশ উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কারো পিঠের উপরের দিকটা উন্মুক্ত থাকতো। হাতাকাটা ব্লাউজ পরা নারীদের বাহু দেখা যেতো। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের ওড়না প্রায় সরে গিয়ে গলায় পেঁচিয়ে থাকতো। এভাবেইতো যুগ যুগ ধরে বাঙালি নারীরা পোশাক পরে আসছেন। তাহলে আমরা কি তাদের এই পোশাককেও অশালীন বলবো?
হাল আমলে ফেসবুকে নেটিজেনরা যেভাবে নারীর পোশাক নিয়ে মেতেছেন তাতে করে মনে হচ্ছে চিরায়ত বাংলার এসব পোশাকও তাদের কাছে অশালীন পোশাক হিসেবেই বিবেচিত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে কোনটাকে আমরা শালীন পোশাক বলবো সে প্রশ্নের মীমাংসা হওয়াটা জরুরী। এতে নতুন প্রজন্মের নারীদের জীবন সহজ হবে।তাদেরকে মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে হবেনা। তারা বুঝতে পারবেন— তারা কী পরবেন এবং কিভাবে পরবেন?
রাজধানী শহরে এখন অনেক উচ্চশিক্ষিত নারী শাড়ী ও সালোয়ার কামিজ ছেড়ে পাশ্চাত্য ধারার পোশাক পরছেন। এটি দু কারণে হচ্ছে বলে মনে করি। প্রথমত কাজে-কর্মে সুবিধা, দ্বিতীয়ত সৌন্দর্য চেতনা। শাড়ীতে আঁচল এবং সালোয়ার কামিজে ওড়না সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে বলে এতে মনযোগে ব্যাঘাত ঘটে এবং স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়।পাশ্চাত্য পোশাকে পরলে এই ঝামেলাটুকু এড়িয়ে চলা সম্ভব বলেই হয়তো শহুরে নারীরা শাড়ি এবং সালোয়ার কামিজের ছেড়ে এসব পোশাক বেছে নিয়েছেন। এতে করে যে তার কাজের উদ্যম বেড়ে যায় তাতো অনস্বীকার্য। কর্মক্ষেত্রে সারাক্ষণ আঁচল কিংবা ওড়না ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে কার ভালো লাগে! তাছাড়া গণপরিবহনে এবং গাড়ী চালানোর জন্যও শাড়ি এবং সালোয়ার-কামিজ খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যজনক পোশাক বলে মনে হয় না। যাতায়াতে সবসময় একহাতে ব্যাগ আর অন্যহাতে আঁচল কিংবা ওড়না সামলাতে কার ভালো লাগে! নাগরিক জীবনের এসব বাস্তবতায় কোন নারী যদি পাশ্চাত্যধারার পোশাক বেছে নেন নিতান্তই কর্মোপযোগী জীবন যাপনের স্বার্থে, তাহলে কি আমরা সে পোশাককে অশালীন পোশাক হিসেবে আখ্যায়িত করবো? যদি করি, সাম্প্রতিক সামাজিক বাস্তবতায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে আমরা তাই করছি— তাহলে নারীর শালীন পোশাকের সংজ্ঞা কী হবে? কোনটাকে আমরা শালীন পোশাক বলবো? নাকি শালীন পোশাক বলতে আমরা কেবলি বোরখাকেই বোঝাতে চাই?
পুরুষের পোশাক:
গ্রামদেশে দেখেছি কৃষকেরা খালি গায়ে ক্ষেতে কাজ করেন। শুধু কী খালি গা! পরনের লুঙ্গিটাকে কোচা দিয়ে এমন শক্ত গিট্টুতে কোমরের সঙ্গে আটকিয়ে নেন যে কাজের পুরো সময়টা লুঙ্গির একটুও নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই। এতে তাদের কাজে মনোনিবেশ করতে সুবিধা হয়। লুঙ্গি কোচা দেয়ার ফলে তাদের উরু উন্মুক্ত হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো গ্রামীণ কৃষকের এই যে খালি গা এবং উন্মুক্ত উরু— একে কি আমরা শালীন পোশাক বলবো?
শহরে ছেলেরা যে টাইট প্যান্ট বা জিন্স পরে তাতে শার্ন্ট ইন করলে তাদের নিতম্বের আকৃতি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠে। বেশি টাইট জিন্সের সংগে টি শার্ট পরলে বা শার্ট ইন করে পরলে অনেক সময় উত্থিত গোপনাঙ্গ স্পষ্ট হয়। ছেলেদের এ ধরনের পোশাককে তো আমরা কখনো অশালীন পোশাক বলে আখ্যায়িত করতে শুনি না। তাহলে নারীর বেলায় কোন একটি পোশাকে তার নিতম্ব কিংবা বক্ষের আকৃতি যৎসামান্য দৃশ্যমান হলে তাকে অশ্লীলতার অপবাদ নিতে হবে? এটা কি কেবলমাত্র পুরুষেরা নারীর এসব অঙ্গ দেখে বেসামাল হয়ে পড়েন— এই কারণে? যদি তাই হয় তাহলে তো সমস্যা পোশাকে নয়, সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। মানসিকতা পরিবর্তন না করে যে সমাজের পুরুষেরা নারীর সমালোচনা করে তার সামাজিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছেন, তারা কি আদৌ একটি সহনশীল ও আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখেন, নাকি বাংলাদেশের নারীদেরকে আফগানিস্তানের মতো বোরখার অবগুণ্ঠনে দেখতে চান— তাদের বিবেকের কাছে এটি আমার বিনীত জিজ্ঞাসা।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী কবি ও সাংবাদিক