‘নারীবাদী’ হতে হলে আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে সবার

হুমায়রা সুলতানা:

ইদানিং বাড়ি ফিরতে খুব করে দেরি হচ্ছে। ইচ্ছে করে যে ফিরছি তা নয়। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে ঢাকা শহরের হুলিয়া বদলে যায়। কাল বের হয়েছি প্রায় চল্লিশ মিনিট পর। বাড়ি ফেরার সেই আগের দিন আর নেই। আগে বাড়ি ফেরার সময় কেমন গা এলিয়ে আসতো। মনে হতে থাকতো কোনরকম খোলস- বল্কল থেকে পরিত্রাণ পেয়ে একটা পাওয়ার ন্যাপ নেয়া যাবে। কিন্তু এখন বাড়ির কাছে আসতেই মনে হয়- বিশাল যজ্ঞ সারতে হবে। সেটা শুরু হয় লিফটের বোতাম চাপার জন্য আলাদা টিস্যু বের করা থেকে শুরু করে বাসায় ঢুকে প্রথম ধাপের স্যানিটাইজ শেষে পুরোদমে নেয়ে হুতুম হওয়া পর্যন্ত। এর মাঝে, সাথে যা যা আছে তাতে স্প্রে করো রে, মাস্ক ফেলো রে, পা ধোও রে। সবশেষে কন্যাদের সাথে সাক্ষাৎ।

কাল শোবার আগে ফেসবুকে গুঁতোগুঁতি করতে করতে একটা লাইভ ভিডিও উঠে এলো। একটা মেয়ে, বাচ্চা মেয়ে। বয়স ১১ কী ১২। নাম সচেতনভাবেই উল্লেখ করলাম না। মেয়েটা এই বয়সেই মেকাপ আর্টিস্ট। কাল সে তার পেইজ থেকে অন্য পেইজের গয়না প্রমোশনের কাজ করছিলো। একসাথে ২০০০+ ভিউ। কিন্তু কী ভয়াবহ সব কমেন্ট আসছিলো ওই ভিডিওটার নিচে। বাচ্চা মেয়েটা সব তোয়াক্কা না করে গয়না দেখিয়ে যাচ্ছে। সে মন্তব্যগুলো পড়ছে না তা কিন্তু নয়। ওর মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবার মতন অবস্থায় ছিলাম না। আমি নিজেও কিন্তু ধাক্কা খেয়েছি এতো অল্প বয়সী একটা মেয়েকে লাইভে দেখে, যে কিনা গয়না দেখাচ্ছে, আবার সুন্দর করে পোজ দিয়ে বলছে স্ক্রিনশট নিয়ে নিতে।
বুড়ো ধাড়ি কতগুলো পুরুষের কমেন্ট দেখলাম—’আপু বগল দেখা যাচ্ছে’। নারীদের কমেন্ট – “তোমার বয়স কত? এই বয়সে এইসব?” এর পর নারী-পুরুষ উভয়ের কমেন্টই চোখে পড়েছে কীভাবে এই কন্যা শিশুকে কী কী শেখাতে হবে। সেই ভাষার ব্যবচ্ছেদ করার বীভৎসতায় নাইবা গেলাম। আচ্ছা, এই যে মেয়েটা এই বয়সে গয়না বা মেকআপ যেটা নিয়েই কাজ করছে, সাবলীলভাবে করছে, কাউকে অসম্মান বা ক্ষতি করে করছে না, তাতে এতো কেন পোড়ায় সবার? যার ভালো লাগছে না, না দেখলেই হতো। আর যার বেশি পোড়ায়, তারা জানার চেষ্টা করুক – কী প্রয়োজনে এই বাচ্চা মেয়েটার পড়ার সময়ে লাইভ করতে হচ্ছে? তার বা তার পরিবারের কী ভীষণ বিপদ? কোন সাহায্য কি প্রয়োজন? কী করতে পারি? আমরা তা করিনি। আমরা আমাদের মস্তিষ্কের সিগনালটাকে মনে না পাঠিয়ে যৌনান্দ্রে পাঠিয়েছি। সত্যিই সৃজনশীল আমরা!

ছোট একটা মেয়ে, কোন অশালীন, অশোভন কিছু না করেই যেভাবে অনলাইন বুলিং এর শিকার হচ্ছিলো নারী ও পুরুষ উভয়ের থেকে, সেখানে প্রকাশ্যে ধূমপান করা মেয়েটি কী ভয়াবহ গর্হিত কাজ করেছে, ভাবা যায়? ওকে তো ওখানেই অনেকভাবে অনেককিছু করা যেত, কিন্তু হয়নি- এর মাধ্যমে সমমনা পুরুষ, এমনকি নারীরাও অনেক বড় মানবিকতার নজির দেখিয়েছেন!

আপনারা শুধু শুধু বিষয়টাকে বড় করে ফেলছেন।

একজন নারীর জন্য একটি সিগারেট যতটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতিকর, কেননা এটি তাকে পুরুষের কাতারের বা সাহসী (!) করে চিহ্নিত করে। নারীবাদীরা এই ব্যাপারে পুরুষ-নারী সমানাধিকার নিয়ে ব্যাগরবাই করলে পুরুষবাদী পুরুষ, কুপুরুষ, কাপুরুষ, ন’পুরুষ, এমনকি পুরুষবাদী নারীরাও বলবেন, ”যাও! এবার রাস্তার ধারে দাঁড়ায়ে মুতের জন্য অধিকার চাও’। খবরদার, সমানাধিকার চাইতে যাবেন না কিন্তু!

তার উপর একটা সিগারেট হলো একটা লম্বাদণ্ড (শলাকা)। এটি পুরুষযন্ত্রের অনুরূপ বা স্বরূপচিত্র প্রকাশ করে বিধায় অবশ্যই এটা শুধুই পুরুষের শৌর্যবীর্য তীরন্দাজ ক্ষমতার প্রকাশক। নারীরা এটি মুখে তুলেছেন মানেই তারা বলছেন, “এই নিন অনুমোদন। আমাকে ধর্ষণ করুন জনাব”! যিনি উন্মুক্ত স্থানে এমন অনুমোদন দিয়েও সুযোগ হাতছাড়া করেছেন, পুরুষেরা, পুরুষবাদী নারীরা যাকে ছানেননি, মথেননি, তাকে নিয়ে আপনারা কোন সাহসে লেখেন? তিনি তো স্বঘোষিত খারাপ নারী।
ধূমপান, সিগারেট, সিগারেট এর কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়া নিয়ে যত কবিতা, গল্প বা রোমান্টিসিজম, সেগুলো সবই পুরুষদের জন্য তোলা। ধোঁয়া মগজে না গেলে সিগনাল ক্লিয়ার বা পটি ক্লিয়ার হয় না। এইসব শুধু পুরুষ সিন্ড্রোম। সিগারেট পুরুষদের জন্য কেবল স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, নারীদের জন্য কেবলই চারিত্রিক কেন? সিগারেট উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর, সমাজের সেটাই বোঝা উচিত, কে, কোথায় খেলো তা নয়। ঠিক তেমনি সমাজের ব্যক্তিগত ও পাব্লিক বাউন্ডারিও বোঝা উচিত।
শেষ করি। আচ্ছা যে দেশের আদিকাল থেকে নানী, দাদীরা চুরুট টেনেছেন, ইতিহাস, পুস্তিকায় যার লেখা, ছবি উভয়ই পাওয়া যায়, সেই দেশে এইসব ভীমরতিওয়ালা মহারথিরা কীভাবে জন্ম নিলো বা বেড়ে উঠলো তা ভেবে কুল পাই না।
খারাপ মানেই বাদ। সকল কথায় নারীবাদ, নারীবাদী টানানো বাদ দিয়ে তার চেয়ে বরং মানবতাবাদে মন দিন আপনারা। কারণ নারীবাদী হতে আপনার ‘মাইলস টু গো’ বস!

শেয়ার করুন: