মহুয়া ভট্টাচার্য:
ইসলামে হাফেজে কোরআন হওয়ার পথটি কিন্তু খুব সহজ বিষয় নয়। কুরআন মজীদের ১১৪ টি সুরা ও ৬৬৬৬ টি আয়াত সম্পূর্ণরূপে মুখস্ত করতে হয় তাদের। এজন্য প্রায় তিন থেকে ছয় বছর সময় লাগে। হাফেজ হতে সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্ত করা আবশ্যক। মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়টিও সম্পন্ন হয় কয়েকটি ধাপে – দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল। এই ধাপগুলিতে মূলত ইসলামিক শিক্ষায় প্রাধান্য পায়। কোরআন ও হাদিসের আলোকেই তাদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়।
এবার আসুন জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। উইকিপিডিয়ায় জুনায়েদ বাবুনগরীর পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে – জুনায়েদ বাবুনগরীর জন্ম ১৯৫০ সালে। তিনি একজন বাংলাদেশি ইসলামি পণ্ডিত, হানাফি সুন্নি আলেম, শিক্ষাবিদ, হাদীস গবেষক, ধর্মীয় লেখক, আলোচক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীর শিক্ষা সচিব ও শায়খুল হাদীস। তিনি হেফাজতে ইসলামের আমির।
এবার বলি তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা। তিনি ২০ বছর বয়সে পাকিস্তানের জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন এবং হাদিস বিষয়ে তাখাচ্ছুছাত (পিএইচডি) করেন।
এবার – তিনি মানে জুনায়েদ বাবুনগরী ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নারীদের পর্দা বিষয়ে বলেছিলেন (হাত মোজা, পা মোজা পরে জীবন্ত টেন্ট হয়ে ঘুরে বেড়ানো, এটার তো কোনো মানে হয় না।) তখন তাঁর এই বক্তব্যকে আপত্তিকর আখ্যা দিয়ে কুরআনের ৭ টি আয়াত ও ৭০ টির মত হাদিস পর্যালোচনা করে এবং তার ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন কোরআনে পর্দার বিধান সম্পর্কে। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বক্তব্যের জন্য তওবা করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এতো গেলো ২০১৯ সালের কথা। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ স্থানীয় উলামা, মশায়েখ ও মুফতিরা বলেছেন -” যাঁরা বলছেন মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়, তারা ভুল বলছেন।সত্যকে গোপন করছেন।এটি কোরআন ও সুন্নাহকে অমান্য করা। অন্য কোনো মুসলিম দেশে ভাস্কর্য থাকলেও উদাহরণ দিয়ে তা জায়েজ করা যাবে না।” এই ছিলো তাদের বিবৃতি। বিবৃতিটিতে সই করেছেন দেশের ৯৫ জন মুফতি তারমধ্যে হেফাজত ইসলামের আমির বাবুনগরীও ছিলেন।
ওপরের তথ্যগুলো কোনো দুুর্লভ তথ্য নয় যে আপনাকে তা বইপত্র ঘেঁটে বের করতে হবে। নেট দুনিয়ায় ঢুকলেই তা পাওয়া সম্ভব। এছাড়া তাঁরা যে শুধু মাত্র ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অর্থ্যাৎ কোরআন, হাদিস বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই মাদ্রাসার চার পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করে হাফেজ, মুফতি হয়েছেন এবং তাদের ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেকোনো গতানুগতিক সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বেশি পোক্ত এটা নিশ্চয়ই আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। কোরআন হাদিসই যাদের শিক্ষার মূল উপকরণ এই বিষয়ে তাঁরা যতখানি বুঝতে পারঙ্গম, অন্যকোনো সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের কাছে সেই পারঙ্গমতা আশা করা যায় না।
এতো কথার অবতারণা করতে হলো, তার কারণ – আমাদের প্রগতিবাদীরা। বলা ভালো আমাদের ইসলামি প্রগতিবাদীরা। গতকাল ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে যে কর্মসূচি পালিত হলো তাতে সর্বধর্মের, সর্বদলের, সব শ্রেনিপেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও পুরোধা ছিলেন কিন্তু মর্ডারেট মুসলিম এবং রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ। এবার দেখুন, এদের প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা করে কথা বললে বুঝতে পারবেন, এনারা প্রত্যেকে নিজের ধর্ম পরিচয়ে অটল, তাঁরা প্রত্যেকে জোর দিয়ে বলবেন – তাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং তারা নামাজ কালাম, রোযা না রাখলেও মুসলমান! এরা বলতে চান কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা ওলামা, মাশায়েখ, মুফতিরা জানেন না! এরা নাকি ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী। অথচ নিজেরাও জানেন না কিংবা প্রমাণ করার মতো উপকরণ নেই যে, আসলেই ইসলাম কী বলে! এদের মধ্যে যাঁরা সংস্কৃতিকর্মী কিংবা “উদারপন্থী মুসলিম” তারা ওয়াজ শুনে হাসাহাসি করেন, তবে মনে মনে ঠিকই সযত্নে ধর্মকে লালন করেন, আর নিজেদের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করেন। শুনেছি দ্বিজাতিতত্ত্বের পুরোধা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তে জানতেন না। তিনি একবার নিজেকে মুসলমান প্রমাণ করতে গিয়ে জামাতের কাতারে দাঁড়িয়ে সেজদা দিতে গিয়ে উল্টে পড়েছিলেন সমবেত কাতারে! ভাবুন তো টিংটিঙে লম্বা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় জিন্নাহ টুপি পরা এক ভদ্রলোক নামাজে সেজদা দিতে গিয়ে তার পশ্চাৎদেশসহ উল্টে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন – এমন দৃশ্য কল্পনা করতে আপনাদের হাসি পাচ্ছে না? তেমনি আমাদের প্রগতিশীলদের এমন দ্বিচারণ দেখেও আমার হাসি পাচ্ছে!
বাইরে এরা সর্বধর্ম সমন্বয়ক। এরা মানে, প্রগতিশীল মুসলমানেরা। তাঁরা ইসলাম ধর্মের মূল ক্রাইটেরিয়া থেকে সরে এসে একটি কাঁটছাট করা ধর্মের চাষ করতে চাইছেন তাদের সুবিধামতো। তারা নিজেদের মধ্যে গান, নৃত্য সহ সংস্কৃতির সমস্ত নিয়ামক কাল্টিভেট করতে চান, মুখে বলবেন তিনি মুসলিম, অথচ ইসলামের কোথাও গান, নৃত্যের অনুমতি নেই কেবল ইসলামিক সঙ্গীত ছাড়া। ভাস্কর্য এবং মূর্তি কোনটিই ইসলাম স্বীকৃত নয় (অন্তত ইসলামিক স্কলারগণ তাই বলেন), তবুও আমাদের প্রগতিশীলেরা ভাস্কর্য রক্ষায় মরিয়া হয়ে গেছেন। যদিও তাদের একাংশও হিন্দুদের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদে দাঁড়ান না। এই প্রগতিবাদীদের মধ্যে কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও আছেন, যাঁদের মূল কাজ হওয়া উচিত ছিলো সব রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তাঁরা কেন দাঁড়ান না? তার ব্যাখ্যাও আছে তাঁদের কারো কারো কাছে। তারা নিজেদের অবস্থানকে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাখতে চান। আর ভাস্কর্য তো আমাদের সংস্কৃতির অংশ। একই অঙ্গে তাঁদের কত রূপ!
এখন এই মুসলমান প্রগতিশীলদের সাথে এসে জুটেছেন অমুসলিম ও স্যেক্যুলার প্রগতিবাদীরা। সুষুপ্ত পাঠকের মতো বলতে ইচ্ছে করে – “এবার বলুন কারা বেশি বিপদজনক? সত্য ইসলাম প্রদর্শনকারী হেফাজত চরমোনাই আই এস তালপবান জঙ্গিরা, নাকি জোচ্চুরি করে ইসলামকে কাঁটছাট করে ইসলামকে ভদ্রভাবে রাষ্ট্রের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা ইসলামি প্রগতিশীলরা?”
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বলয় মিলেমিশে একাকার হয়ে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে যাদের কাজ, গাছেরও খাওয়া তলারও কুড়ানো। এরা কেউ সাহস করে বলতে পারেন না রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কি!? আর যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো কেবল বিদ্বেষ বাড়ায়, হানাহানির মন্ত্রণা দেয় – আমি আজ থেকে সেই সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করলাম।