স্পর্শের ভিতর, স্পর্শের বাহির

শাহাজাদী বেগম:

জয়িতার তৃতীয় কেমো’র পরে বেশ কিছুটা সময় চলে গেছে, স্বাভাবিক জীবনে কিছুটা স্থিতু হবার সে কী প্রাণান্ত চেষ্টা! এর মাঝে ডাক্তারের কাছে ফলো আপের তারিখও চলে গেল, ইন্ডিয়া থেকে আনা ঔষধগুলো আরও আগেই শেষ হয়েছে। ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা কঠিন হচ্ছে। শরীরে ইতিমধ্যে নানা উপসর্গ আবারও মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মোটামুটি চাকরি, সেটাও দুই জায়গায়। দুজনের মা-বাবা থাকেন অন্য দুই জায়গায়। এই চার সংসারের খরচ মিটিয়ে খুব কষ্ট করে চিকিৎসাটা চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সমস্যা বাঁধালো এমব্যাসি, এখনও ভিসা দিচ্ছে না। আর এই সমস্যাটা কোনভাবেই এখন উতরানো যাচ্ছে না।

তোর বাঁকা ঠোঁটে শ্লেষের হাঁসিটা এখান থেকেও বেশ স্পষ্ট। কিছুটা অভিমানি হয়ে তাচ্ছিল্ল্যভরে বললি,
“সবই তো জানো দিদিভাই, তবুও কার কোথায় কুঞ্জবন সেসব নিয়ে মাথা ঘামাও কী করে?“
জানিস জয়ি, ঠিক এই সময়গুলোতে আমার নিজেকে মানুষ হিসাবে খুব নিচুমানের মনে হয়। ঠিকইতো, তোর জন্য একেকটা দিন বেঁচে থাকাই কত কঠিন! অথচ কারো কারো বেঁচে থাকবার জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে কুঞ্জবন লাগে, কখন কোথায় গাড়ি নষ্ট হবে, কোথায় জ্যামে বসে থাকতে হয় কে জানে!
তুই বললি, “ঘা-টা ক্রমশঃ দগদগে হচ্ছে, বড্ড কষ্ট দিদিভাই। দেশের ডাক্তারদের ভয় করে। ওদের ভুল চিকিতসাতেইতো………। করোনাটার কি এমন সময়েই আসতে হয়, বলো? অনলাইনে অফিস, অনলাই্নে সম্পর্ক! কি অদ্ভুত না? কষ্টের সময় হাত ধরে বসে থাকার সুযোগ নেই। কপালের উপর একটু স্নেহের বা ভালোবাসার স্পর্শ, সেই উপায়ও নেই। হায় করোনাকাল!“

তুই ঠিকই বলেছিস জয়িতা। করোনা, একটা ভাইরাস… এই এত্তটুকুন, ঠিক কতটুকুন? পৃথিবীতে আক্রান্ত ২১ মিলিয়ন মানুষের শরীরে যত ট্রিলিয়ন করোনা ভাইরাসের বাস তার সবটুকু মিলে একবিন্দু পানির সমান। এই ভাইরাস আবার সাবানপানিতেই ধ্বংস হয়। অথচ সেই ভাইরাসকেই আমরা সামলাতে পারছি না, তার আক্রমণে সারা পৃথিবী একেবারে নাস্তানাবুদ। দুনিয়া জুড়ে জীবনযাত্রা প্রায় অচল। মানুষ মোটামুটি গৃহবন্দী। সবচেয়ে কষ্টকর হলো ছোঁয়াছুঁয়ি করা যাবে না, ছয় ফুট দূরে থাকতে হবে। তুই স্মিত হেসে বললি “স্পর্শ কারণ, তাই স্পর্শ বারণ।“

অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও একই অবস্থা। শাট-ডাউন, লক-ডাউন, কোয়ারেন্টিন এসবই এখন জীবনের বাস্তবতা। ওয়ার্কিং ফ্রম হোম, অন লাইন ক্লাস, অনলাইনে হোম ডেলিভারি নিতান্তই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, দুইসপ্তাহে একদিন বের হয়ে কাঁচা বাজার আর ঔষধপত্র, প্রায় ৫ মাস হলো এমনই গৃহবাস আমাদের। বাস্তবতার কারণে পার্থিব জগতে শরীরী যাতায়াত যখন সীমিত তখন অন্য দুই জগতে মানুষের বিচরণ অবারিত-একটি মনের জগত আর অন্যটি ভার্চুয়াল জগত। সেই মনের জগতের কল্পনা বা ফ্যান্টাসিতেই আমাদের বেশি পদচারণ।

কারণ ফ্যান্টাসি আর ভার্চুয়াল জগত মিলে কখনও কখনও সত্যের কাছাকাছি অনুভূতি তৈরি করে। কাজেই মানুষের শান্তি, স্বস্তি, তৃপ্তি এগুলোর এতো বছরের লালন করা অনুভূতিগুলো ক্রমশঃ একটা জটিল অনুভূতিতে রুপান্তরিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ আসার আগে ভার্চুয়াল জগতের যতটা ব্যবহার হতো তাতেই আমরা আতংকিত ছিলাম। আর এখন সেই ব্যবহার কতগুণ বেড়েছে তার সঠিক তথ্য আমার কাছে নেই। কিন্তু অনুমান করতে পারি পেশা, বিনোদন, আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ, আড্ডা, পড়াশোনা, এমন অসংখ্য কারণে হয়তো হাজার গুণ বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে সম্পর্কের জটিলতা, জীবনের জটিলতা। বাস্তব জীবন ক্রমশঃ দখল করে নিচ্ছে এইসব ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আমরা শরীরী সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এক বাড়িতে থেকেও মা-বাবার সাথে কথা হয় না, স্পর্শ করা হয় না, সন্তানদের জড়িয়ে ধরা হয় না। একই বাড়িতে থেকে একেকজন একেক ঘরে বসে ইন্টারনেটে ক্যারাম কিংবা লুডু খেলছি। পাশের ঘরে অসুস্থ বাবার হাত ধরে বসা হয় না, বরং ফেইসবুকে বাবার অসুস্থতার স্ট্যাটাস দিয়ে লাইক-কমেন্ট গুনতে গুনতে দিন পার করি। অথচ সামনাসামনি একটা লুডু নিয়ে বসলে চারজন মানুষ খেলতে পারে কয়েকজন মানুষ দেখতেও পারে। সামনাসামনি দেখা হয়, কথা হয়-খুনসুটি হয়। তাতে কঠিন করোনাকালে নিজেদের একা মনে হয় না, বরং কাছের মানুষদের আরও কাছের মনে হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নিবিড় হয়, মায়া বাড়ে, মমতা বাড়ে, একে অন্যের উপর নির্ভরতা বাড়ে।

এই যে ফেইসবুকে কত কত সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্যাটিক, সোশ্যাল মিডিয়া ডিনামিকস এ ভর্তি। তুই প্রশ্ন করলি, “ভার্চুয়াল যোগাযোগে এতসব দরকার কেন দিদিভাই? এতো এতো ইমোজি, রিএক্ট করার জন্য লাইক, লাভ, কেয়ার, হা হা, ওয়াও, স্যাড, এংরি এতো অপশন কি আসলেই দরকারি? কী হয় এতো এতো লাভ, লাইক, কেয়ার দিয়ে? অন্যগুলো স্থির হলেও ‘কেয়ার’ রিয়াকশন আবার নড়েচড়ে! লাইক আর আনলাইক ছাড়া আর কোন রিএকশন সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকার দরকার নেই।“

জানিস জয়ি, ঐ “কেয়ার” রিয়াকশনে হৃদপিণ্ডটাকে দুইহাতে এমন করে বুকের মধ্যে আগলে ধরে ওটা দেখলেই আমি আবেগে অবশ হয়ে যাই।
লিখে অনুভূতি প্রকাশের বদলে আমাদের বিভিন্ন ইমোজি ব্যবহার করাও বেড়েছে। লিখে যাকে ‘ভালোবাসি’ বলা যায় না, ‘উম্মা’ দেওয়া যায় না, ‘বুকে জড়িয়ে’ ধরার কথা বলা যায় না-খুব সহজেই তাকে এইসব রিএকশন দেওয়া যায়। এটি একটি শর্টকাট পদ্ধতি এবং এতে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফলে খেলোয়ার, সওদাগর কিংবা আবেগ শিকারি নারী-পুরুষের জন্য বেশ সুবিধা হয়েছে। চিন্তার বিষয় হলো আমাদের সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল জগতের লাভ-লাইকের হিসাব নিকাশের মধ্যেই সার্থকতা খুঁজতে শুরু করেছে। খেলোয়াড়দের জন্য বিষয়টি জমে উঠলেও অপরপক্ষের জন্য বেশ ভোগান্তি তৈরি করছে। কে, কাকে, কতটা, কী ইমোজি, জিফ কিংবা রিএকশন দিচ্ছে সেসব ভার্চুয়াল জগতের অশরীরী সম্পর্কেও বাড়াচ্ছে জটিলতা। ভার্চুয়াল জগতের এইসব জটিলতা বাস্তব জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো জেন্ডার, বয়স, পদমর্যাদা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষ বিভিন্ন মানুষকে মোটামুটি বাজারে তুলে ছেড়েছে। প্রায়ই আমরা পছন্দের মানুষটির (নারী/পুরুষ) দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসি।

সওদাগরি মানসিকতার মানুষগুলো তখন পছন্দের পণ্যটি বাছাই করে টোপ দেয় মানে নক করে। কিছু কিছু টোপ লেগেও যায়।
তুই বললি, “আর যদি পছন্দের মানুষ পোস্টে একটা ‘লাভ’ বা ‘কেয়ার’ রিএকশন দেয় কিংবা কমেন্টে একটা ‘টাইট হাগ’ জিফ অথবা ‘উম্মা’ ইমোজি তাহলে?”
আমি হেসে বলি, “তাহলে আর কি- কুঞ্জ সাজিয়ে সারারাত অপেক্ষা!”
তুই কপট বিরক্তি দেখিয়ে বললি “উহঃ দিদিভাই, আবার সেই কুঞ্জ! তুমি পারোও বটে!“
হাঃ হাঃ হাঃ অনেকদিন পর দুজনেই শব্দ করে হাসলাম।

ভার্চুয়াল জগত আর বাস্তব জগতের এতোটা মিথস্ক্রিয়ার দক্ষ কারিগর হলো স্মার্ট ফোন আর আনলিমিটেড ওয়াইফাই। মশা্রির ভিতর কিংবা বাথ্রুমের ভিতর সবখানেই এই মহাশয়দ্বয়ের অবাধ বিচরন। ফলে একই মশা্রির ভিতরে থাকা দুইজন মানুষ দুইটা স্মার্টফোনে দূরের কখনোই না দেখা, স্বল্প দেখা কিংবা একেবারেই অচেনা মানুষটির সাথে যোগাযোগেই ব্যাস্ত। হাত বাড়ালেই যাকে ছোঁয়া যায় তাকে ছোঁয়ার চাইতে মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটস আপে ধরা-ছোঁয়ার বাইরের কাউকে “উম্মা” ইমোজি পাঠানোতেই বা পেতেই বেশী সুখ যেন। এই ফেসবুকিয় জীবন আর অশরীরী সম্পর্কগুলোর বেশির ভাগই একপাক্ষিক হয়ে যায় কোন এক পর্যায়ে গিয়ে। এগুলোর ভিত্তিও বায়বীয়।
তুই উদাস হয়ে বললি, “অথচ এই বায়বীয়তাও কখনো কখনো নিঃশ্বাসের সাথে ফুস্ফুস অব্দি পৌঁছে যায়। আবার কখনো আত্মাটাও ছুঁয়ে ফেলে, কী সাংঘাতিক! তাই না দিদিভাই?”

কী জানি, তাই হবে হয়তো। ছোটবেলা থেকে অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করতে করতেই হয়তো অদেখা, না পাওয়া ফ্যান্টাসাইজড সুখগুলোকেই বেশী মধুর মনে হয়। অলৌকিকতার প্রতিই যেন আমাদের বেশী আকর্ষণ।

জয়ি, ভালবাসা আর প্রার্থনাকে প্রায়ই আমি আলাদা করতে পারি না। শুধু মনে হয় ভালোবাসার শক্তি আমার হাতে, কিন্তু প্রার্থনার শক্তি অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার হাতে। তোর জন্য এই দুটোর কোনটার কোন কমতি হবে নারে। শুধু কখনো যদি তৃতীয় শক্তির প্রয়োজন হয়, তবে বলতে সংকোচ করিস না যেন।

লেখক পরিচিতি: উন্নয়ন পরামর্শক

শেয়ার করুন: