সুচিত্রা সরকার:
বালিকা বয়সে রোজগার করতাম না। তবে কোনোদিন লিপস্টিক, জামা আর হাতি ঘোড়ার আবদার করিনি মায়ের কাছে। টিফিনের টাকা জমিয়ে চাচা চৌধুরী, টিনটিন, তিন গোয়েন্দা কিনতাম। পাঁচ ক্লাস বয়সে মীনা কার্টুন আমাকে নারীবাদ শিখিয়েছে। শিখিয়েছে— সংসারে, ছেলেমেয়ে সমান।
মেয়েরা সমান হলে অন্যের কাছে হাত পেতে চলে না, শিখেছি।
বিধবা মা প্রাচুর্য দিতে পারেননি। দিয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্য। অভাব ছিল না, আবার কাড়ি কাড়ি টাকাও নয়। ঢাকার দামি স্কুলে আমরা পড়েছি। বদলে হয়তো মায়ের গায়ে দামি শাড়ি থাকতে পারতো। মায়ের এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিবিটিজে (কুর্শি কাটা) আমাদের দু ভাইবোনের এক্সট্রা কারিকুলাম (গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয়, ছবি আঁকা) এক্টিবিটিজ বিকশিত হয়েছে।
তারপর আর নয়।
এসএসসি পরীক্ষার পর সবাই গেছে ঘুরতে। শেষ পরীক্ষার পরদিন থেকে আমি টিউশনি শুরু করি। না, আমার টাকায় সংসার চলেনি। আমার কলেজ বা ভার্সিটি ফিও নয়। তবে রোজগারের অর্থে অনেক কিছু করেছি। হাতখরচ, মাকে গিফট দেয়া, নিজের জামা, জুতা— সব।
ছাত্র ইউনিয়ন করেছি, কেউ বলতে পারবে না একদিনও পঞ্চাশ টাকা ধার করেছি। বরং অনেকের চা কফির বিল পরিশোধ করেছি। অনেকের রিকশা ভাড়া। আরো অনেক বেহুদা খরচ— সেসব আদারে বাদারে খরচ না করলে দশ পনেরো লাখ টাকা এমনিই জমে যেতো। যতদিন টিউশনি করেছি, মেরুদণ্ড সোজা রেখে করেছি। যেখানে সম্মানহানি হয়েছে, পরদিন আর যাইনি। তাই শহরে আমার অনেক ছাত্রছাত্রী।
ডিসেম্বর মাসে বসে থাকবো? পাশের বাড়িতে কারচুপির কাজ করতো শাড়িতে। কী আসে যায় কাজে? এনে করলাম। কী কষ্ট! চরম বোকামি ছিল সেই এক্সপেরিমেন্টটা। একদম ভুখা না হলে এ কাজ এতো অল্প টাকায় কেউ করে না। সারা মাসে একটা শাড়ি করে ছয় হাজার পেয়েছিলাম। বদলে আমার চোখের এক্সিজ ছয়ের বদলে চার হয়ে গেল। তবে ব্লক, বাটিকের কাজ করে বেশ রোজগার হয়েছিল আমার টানা দু বছর।
ঠিক দশ বছর যেদিন হলো, টিউশনি ছেড়ে দিলাম। তারপর কত কী করেছি! কখনও এনজিও’র দাতা সংস্থার প্রধানের পিএইচডি সহকারি। আবার কখনো জরিপ গবেষণায় ঘেমে নেয়ে সারা। ফিল্ম আর্কাইভে গবেষণা করে দুই বারে এক লাখ। পত্রিকায় কন্ট্রিবিউটার, নিউজ এজেন্সিতে রিপোর্টার, এমনকি বাংলা একাডেমীতে তরুণ লেখক প্রকল্প বা ফোকলোর প্রকল্প। বা নিউজ নেটওয়ার্কে ক্লাস করে মাসে বারো হাজার। অথবা সেইভ দ্য চিলড্রেনের অনুবাদ, পেইজ মেকআপে ত্রিশ। বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ।
পাঞ্জেরী গাইড বইয়ের ক্লাস সেভেনের বাংলাটার অর্ধেক ছিল আমার করা। বিনিময়ে পঁয়ত্রিশ পেয়েছিলাম।
সৎ উপায়ে বর্ণিল কাজের অভিজ্ঞতা। সেসব অর্থের এক পয়সাও জমানো নেই। কারণ শহরে আমার কোনো ধার নেই। কারও কাছ থেকে টাকা মেরে দেবার নেই কোনো রেকর্ড। আছে কিছু ছেলেমেয়ের বছর বছর বই, খাতা পেন্সিল বক্স, পরীক্ষার ফিস দেবার ইতিহাস। আছে বন্যা, খরায় আক্রান্ত শহরের পাশে দাঁড়ানো।
এসব না করলেও পারতাম। হতাম আর দশটা মেয়ের মতো! মাস শেষে অন্যের রোজগারে ভাগ বসাতাম! অন্যের মানিব্যাগের অর্থ নিজের ভাবতাম।তাহলে হয়তো দুপুরে ঘুম আর আরও আয়েশে জীবন কাটাতে পারতাম। তবে তাতে স্বাবলম্বী হতাম না কখনোই। আর অন্যের অবলম্বনে চলা মেয়েদের মুক্তি হয়? আমার যে মুক্তিটা লাগবেই। হোক এ জন্মে বা পরজন্মে।
পিস্তল বা বন্দুক নয়, এ মুক্তির প্রধান শর্ত, অর্থনৈতিক মুক্তি। মানে টাকা— নিজের। মানে পকেট—নিজের। বা মানিব্যাগ বা ভ্যানিটি। বা ব্যাকপ্যাক।
নিজের, হতেই হবে।
তাই আমার বেশির ভাগ কামিজে পকেট। প্রিয় এক্সসোরিজ— মানিব্যাগ। তবু সারা রাত রামায়ন গাওয়ার পর শুনতে হয়, শয়তান মেয়ে অন্যের মানিব্যাগে চলে। কী আর বলি! দিদিমা বলতেন, নাতনী গো নাতনী, মাইয়া হইয়া জন্মাইছো, রানতেও হইবো, কানতেও হইবো।
হাহ! নারী জন্ম! হাহ!
৬.৮.২০২০
রাত ১.৫৭ মিনিট
লমোদা লেন