নারীরা কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক হয়!

অজন্তা বড়ুয়া:

অনেকেই বলেন পুরুষতান্ত্রিক নারী। নারী আবার পুরুষতান্ত্রিক হয় কীভাবে! হ্যাঁ, নারীরাও হয় পুরুষতান্ত্রিক এবং সেই পুরুষতান্ত্রিকতার ফলাফল সচরাচর দেখা পুরুষতন্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। দুই ধরনের পুরুষতান্ত্রিক নারী দেখা যায় আমাদের সমাজে। একজন ক্ষমতাহীন এবং একজন ক্ষমতাবান।

বাংলাদেশে একটি কন্যা শিশু শৈশবে যখন তার আশপাশটা বুঝতে শুরু করে তখন থেকেই তার মাথায় একটা বিষয় চমৎকারভাবে গেঁথে দেওয়া হয়। সেটি হলো, সে একজন মেয়ে মানুষ, তাকে হতে হবে কোমল। কঠোর হয় পুরুষরা। তার চারপাশের সমস্ত কিছুর সাথে তাকে মানিয়ে যেতে হবে এবং এই মানিয়ে যাওয়াটা শুরু হয় পুরুষতন্ত্রের গঠিত নিয়মগুলোকে জোড়ালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

সে দেখতে পায় সে পুতুল খেললে মানুষ বাহবা দেয়, সে ওড়না পড়লে সবাই প্রশংসা করে, সে বাইরে কম গেলে তাকে লক্ষ্মী বলা হয়। তারই কোনো বান্ধবী যদি ছেলেদের পোশাক পরে, তাহলে সে পরিচিত হয় উচ্ছৃঙ্খল ও জংলি হিসেবে। এই লক্ষ্মী হবার বাসনার সাথে সাথে মেয়েটি তার অবচেতন মনে লালন করতে থাকে পুরুষতান্ত্রিকতা।

কৈশোরে মেয়েটি দেখে পুরুষদের মন যুগিয়ে চলাই হলো মেয়েদের একমাত্র অর্জন। মেয়েদের নিজের ইচ্ছার কথা অকপটে বলতে নেই। মেয়েদের ইচ্ছা হলেও অনেক কিছু করতে নেই। মেয়েদের বেশি কথা বলা বারণ। মেয়েদের পড়াশোনা করতে হয় শুধুমাত্র ভালো পরিবারে বিয়ে হবার জন্য। আর্থিক সমস্যা না হলে মেয়েদের ইনকাম করার কোনো প্রয়োজনই নেই। এর বাইরে চলতে গেলে অত্যাচারিত হতে হয়, নির্যাতিত হতে হয়, মুখ ঝামটা খেতে হয়। আর ছেলেরা তো রাস্তায় টিজ করবেই, ছেলেরা অশ্লীলভাবে তাকাবেই, ছেলেরা বউ থাকলেও অন্য মেয়ের কাছে যাবেই। মেয়েদেরকেই ছেলেদের ভুলিয়ে ভালিয়ে এসব ম্যানেজ করতে হয়। যে মেয়ে এসব ম্যানেজ করতে পারবে না সে আবার কোনো মেয়েমানুষ নাকি!

মেয়েটি বড় হতে হতে আরও দেখতে পায় তার আশপাশের নারীদের কাছে জীবনের একমাত্র মানে হলো সাজপোশাক, স্বামীর সম্পত্তি আর গয়নাগাটি। যার এইসব বস্তু কম আছে তাকে হাতে গোনাই যাবে না সেভাবে। মেয়েদের গল্পের মধ্যে এই বিষয়গুলোই মুখ্য। মেয়েমানুষের পরিচয় তার স্বামীর স্ট্যাটাসে। স্বামীর আইন্ডেন্টিটি মানেই হলো নিজের আইন্ডেন্টিটি। কেননা পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তাদের এসব শিখিয়েছে।
মেয়েটি এই আইন্ডেন্টিটি নিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখতে থাকে। স্বপ্ন পূরণও হয়। স্বামীর অবস্থানের কারণে সমাজ সামনাসামনি তাকে খুব তোয়াজও করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সবকিছু এক লকমায় হাতের কাছে পেয়ে যাওয়া সেই পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার মেয়েটিকে কখনোই কোনো লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি, কোনো সংগ্রাম করতে হয়নি। কেননা সে জন্মের পর থেকেই তার ইচ্ছাকে পুরুষতান্ত্রিকতার হাতে জিম্মি করে রেখেছে। সে নিজের পরিচয়টা বুঝে উঠতে পারেনি, সে এই সমাজে তার নিজের প্রয়োজনই কখনো বুঝে উঠতে পারেনি। নিজের অধিকারটাই বুঝে উঠতে পারেনি। তাকে শেখানো হয়েছে তার একমাত্র কাজ রান্নাঘর সামলানো আর বাচ্চা উৎপাদন। নিজের কোনো ইচ্ছের প্রয়োজন হলেও সেটা তার পরিবার বা বিয়ের পর স্বামীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করেছে।। পরিবার বা স্বামী যদি অনুমতি দেয়, তবেই তার ইচ্ছার অনুমোদন মিলেছে। তার স্বাতন্ত্র্যবোধই তৈরি হয়নি। এভাবেই সে হয়ে উঠেছে একজন পুরুষতান্ত্রিক নারী। কাজেই পুরুষতান্ত্রিকতার সাথে যেসব বিষয় বৈপরিত্য তৈরি করে সেগুলোকেই তার কাছে মনে হয় নোংরামি।

এইসব ক্ষমতাহীন পুরুষতান্ত্রিক নারীর কাছে নিপীড়িত নারী দেখলেই মনে হয়, নিশ্চয়ই মেয়েটি বাড়াবাড়ি করেছে, “এক হাতে তো আর কখনো তালি বাজে না”। তার কাছে ধর্ষণের শিকার কাউকে দেখলে মনে হয় নিশ্চয়ই সে অশ্লীল পোশাক পরেছে, নয়তো রাস্তায় তো আরো অনেক মেয়ে ছিলো, তাদের তো কিছু হলো না। রাত করে কোনো মেয়ে বাসায় ফিরেছে, তার কাছে মনে হয় এতো রাতে কোনো ভালো মেয়েমানুষ তো বাইরে থাকে না। কর্মক্ষেত্রে কেউ হ্যারেজড হলে মনে হয়, নিশ্চয়ই বস কমিটমেন্ট ফুলফিল করেনি তাই মেয়েটি বানোয়াট কথা বলে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

বাসায় ছোট বাচ্চা রেখে কোনো মেয়ে কাজে গেলে তার মনে হয় মেয়েটা কোনো মায়ের জাতই না, ছোট বাচ্চা রেখে কাজে যেতে হলে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার কী দরকার ছিলো! আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে গিয়ে কোনো মেয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করলে তার মনে হয়, মেয়েটার বিয়ে না হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ইতিহাস আছে ! ডিভোর্স হয়তো দু’জনের সম্মতিতেই হয়েছে, কিন্তু তার মনে হবে দোষটা কেবল মেয়েরই, সংসার করার, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা মেয়েটার ছিলো না। কোনো মেয়ে নিজ চেষ্টায় ভালো অবস্থানে গেলেও মনে হয় মেয়েদের আবার কিসের যোগ্যতা, সবই হলো পুরুষদের সাথে দেওয়ানেওয়ার খেলা। ক্যারিয়ার গোছানোর কথা চিন্তা করে বাচ্চা নিতে দেরী করলে মনে হয় নিশ্চয়ই মেয়েটার শারিরীক সমস্যা আছে।

ক্ষমতাহীন পুরুষতান্ত্রিক নারীরা এইসব মনে হওয়াগুলি গসিপ করতে ভালোবাসেন। তাই এসব শেয়ার করতে গেলেই সে নিজের মতো আরো অনেককেই পেয়ে যায়, যারাও একইভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। পুরুষতান্ত্রিক চর্চা বাইরে থেকে বেশ প্রশংসা দিলেও মেয়েদেকে এতোটুকুও সম্মান দেয়নি। সম্মানবোধের অভাবই সেইসব নারীদেরকে হীনমন্য করে তুলেছে যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি তথাকথিত ” আন্টি বা ভাবিসম্প্রদায়” যাদেরকে নিয়ে আবার কিনা পুরুষরাই বেশ মজা করে। কয়েকজন নারী একসাথে থাকলেই পুরুষদের মনে হয় সেখানে এর ওর নামে বদনাম এবং সাজ পোশাক ছাড়া কোনো প্রোডাক্টিভ আলোচনা হতেই পারে না। যেটা পুরোপুরি যে অমূলক তা বলাও যায় না। কিন্তু এগুলো যে পুরুষতান্ত্রিকতারই উৎপাদিত ফসল এটা তাদেরকে কে বোঝাবে!

ক্ষমতাবান পুরুষতান্ত্রিক নারীরা আবার খুব ভয়ংকর। তারা পুরুষতন্ত্রের কঠোরতাকে এক্সারসাইজ করে পৈশাচিক আনন্দ পায়। তারা নিজেদের চিন্তাধারাকে যেমন কুক্ষিগত করে রাখে তেমনি যেসব নারীরা এইসব বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চান তাদের পেছন থেকে টেনে ধরেন ঠিক কাঁকড়ার মতো। তারাই একজন মা, একজন শ্বাশুড়ি, একজন বোন হয়ে আরেকজন মেয়ের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা তৈরি করেন। সংসারে কোনো মেয়ের নির্যাতনের ঘটনায় মেয়ের ব্যবহার আর চরিত্রকে দোষারোপ করেন। স্বামীর উদাসীনতাকে স্ত্রীর ব্যর্থতা হিসেবে মূল্যায়ন করেন। কোনো মেয়ের সফলতাকে ঈর্ষা করেন। এদের কেউ কেউ পুরুষদের কাঁধে পা রেখেই তড়তড় করে এগিয়ে যান। কোনোরকম সংগ্রাম ছাড়াই স্মুদলি সমাজের উচ্চ আসনে আসীন করে নিজেকে আইকন বানিয়ে রাখেন। অথচ বাসায় ছেলের বউকে নির্যাতন করেন। কাজের মেয়েটা কথা না শুনলে খুন্তির ছ্যাঁকা দেন। কথায় কথায় ক্ষমতার বাহাদুরি দেখান। বহুদিন ধরে পুরুষতন্ত্রকে লালন করে আসা এইসব নারীরা ক্ষমতা দিয়েই পুরুষতন্ত্রের চর্চা করতে থাকেন।

এইসব পুরুষতান্ত্রিক নারীদের জন্যই মেয়েদেরকে জেনারালাইজ করা হয় হিংসাপ্রবণ জেন্ডার হিসেবে। অথচ এই হিংসাপ্রবণ জেন্ডার তৈরি করেছে স্বয়ং পুরুষতন্ত্র নিজেই। নারীরা কেবল এর শিকার হয়েছে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর শুধুমাত্র অত্যাচারিত হয়ে নয়, অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজের মধ্যে পুরুষতন্ত্র লালন করেও।

এবার নারী দিবসের থিম ছিলো “Each For Equal”। এই থিমটা যতটা না নারী পুরুষের সমতা নির্দেশ করে, ততটাই সকল স্তরের মেয়েদেরও সমতা নির্দেশ করে। একে অন্যের ভালো নিয়ে ঈর্ষা করা নারী যখন বুঝতে শিখবে পুরুষতান্ত্রিকতাই তাদের নারী হিসেবে আলাদা করে রেখেছে, সেদিন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সকলের জন্য আরো সহজ হবে। নারীরা তাদের গীবত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে, কোনো নারীর সফলতা অন্য নারীর জন্য আর হিংসার কারন হয়ে দাঁড়াবে না।

লেখক: অজন্তা বড়ুয়া, সিনিয়র এডুকেশন কনসালটেন্ট

শেয়ার করুন: