বাংলার পুরুষ বা নারী ট্যাবু ভাঙার ব্যাপারে এক চুলও এগোয়নি

রীতা রায় মিঠু:

বাংলার পুরুষ সমাজ, নারীসমাজ গুলতেকিনের বিয়েতে খুব আনন্দ প্রকাশ করছে, তার মানে বাংলার পুরুষকূল নারীকূল কি একযোগে আলোকিত হয়ে উঠেছে?

মোটেও না, এমন ভাবলে পস্তাতে হবে। এই উচ্ছ্বাস আনন্দ নিছক শাওনের বিরুদ্ধে রাগ প্রকাশের উপলক্ষ মাত্র।

যে নারীকূল আজ গুলতেকিনের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে দ্বিতীয় বিবাহ করাকে পুরুষ শাসিত সমাজ বদলে দেয়ার উদাহরণ হিসেবে দেখছে, এই নারীকূলই তসলিমা নাসরিনকে বেশ্যা পতিতা বলে দিনরাত গালিগালাজ করে।

আর যে পুরুষকূল গুলতেকিনের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে দ্বিতীয় বিয়ে করাকে বাংলার নারী সমাজের পর্দায় ঢাকা দিনবদলের সূচনা হিসেবে দেখছে, সেই পুরুষকূলই নিজের মধ্যবয়সী ডিভোর্সি বা বিধবা বোন, ভাগ্নী, প্রাক্তন স্ত্রীকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে দিবে না, তার পরিবার বংশের মান ইজ্জত রক্ষার কথা বলে আটকে দিবে।

‘গুলতেকিন এতো বছর একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে’ বলে যে বঙ্গসমাজ আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, সেই সমাজেরই প্রতিটি ঘরে একজন নারী, একজন পুরুষ যে দিনের পর দিন নিঃসঙ্গতায় ভুগতে ভুগতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তাকে একটু সঙ্গ দেয়ার কথা ভাবে না!

গুলতেকিনের আনন্দে আনন্দিত পুরুষসমাজ হুমায়ূনকে গালি দিচ্ছে প্রথম স্ত্রীর প্রতি অবিচার করেছে বলে, অথচ ঘরে ঢুকে নিজের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়েও দেখছে না, সেই মুখে পুলকের ছোঁয়া আছে নাকি বেদনার ছায়া দেখা যায়!

বাংলার মানুষ সিনেমা দেখতে ভালোবাসে তবে নিজের সংসারে নয়, অন্যের সংসারের সিনেমা খুব এনজয় করে।

এটা যদি গুলতেকিন না হয়ে তসলিমা নাসরিন হতো, অথবা আমিই হতাম, তাহলে দর্শকসমাজ এভাবে হাতে তালি দিয়ে লাফাতো না।
বরং তসলিমার জানাজা পড়াতো।

এই উচ্ছ্বাস আর কিছু নয়, শাওনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখানো। নারীর প্রতি মহানুভবতা থেকে এই উচ্ছ্বাস নয়, তাই যদি হতো, তাহলে ওরা শাওনের প্রতিও মহানুভবতা দেখাতো।

হুমায়ূন ছিলেন বাংলার পাঠককূলের শিরোমণি। হুমায়ূন যদি শাওনের পরিবর্তে গুলতেকিনের বিয়ের সংবাদে উচ্ছ্বসিত নারীদের যে কোনো একজনের প্রেমে হাবুডুবু খেতো, সেও তখন গুলতেকিনের কথা ভুলে চার সন্তানের পিতা, পঞ্চাশোর্ধ বিবাহিত হুমায়ূনের গলায় মালা পরিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো।

শাওনের বিরুদ্ধে বিবাহিত নারীসমাজই অভিযোগ করছে, শাওন হুমায়ূনকে গুলতেকিনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। অথচ তাদের জানা থাকার কথা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আস্থা আর বিশ্বাস যদি থাকে, কোনো শাওনের ক্ষমতা নেই একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে কেড়ে নেয়ার।

শাওনেরই যত দোষ, এমনই ধারণার একজনকে বললাম, যে সম্পর্কে অনেক আগেই সূক্ষ্ম ফাটল দেখা দেয়, সেই ফাটল আড়াল করে সম্পর্ক আলতোভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, কিন্তু সেই ফাটলে যদি যেকোনোভাবে বাইরে থেকে আলতো আঘাত লাগে, ফাটল আর ফাটল থাকে না, ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

দোষ কার হয় তখন? যারা ফাটল বাইরের আঘাত থেকে আড়াল করতে পারেনি তাদের, নাকি যার গায়ে আলতো ধাক্কা লেগে ফাটল ভেঙে গেলো তার!

শাওন ছিল বাইরের ধাক্কা মাত্র, হুমায়ূন গুলতেকিনের সম্পর্কে ফাটল অনেক আগেই ধরেছিল।

যারা ভাবছে গুলতেকিনের দ্বিতীয় বিয়ে দেখে বাংলার পুরুষ নারী সকলেই এখন মুক্তমনা হয়ে যাবে, সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।

বোন, মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে প্রতিদিন লাথি ঝাঁটা খায় জেনেও যে বঙ্গসমাজ সাহসী হয়ে নিজের মেয়েকে, বোনকে অত্যাচারী শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে না, যে সমাজ জোর করে মেয়েকে, বোনকে সব জেনেশুনে শ্বশুরবাড়ির আগুনে ছুঁড়ে দেয়, সেই বঙ্গসমাজই কিনা মধ্যবয়সী এক নারীর দ্বিতীয় বিয়ে দেখে এতx উৎফুল্ল!

আমার এই লেখাটায় বা এই সম্পর্কিত কোন লেখাতেই গুলতেকিনের বিয়েতে দেয়া অভিনন্দন দোষের না গুণের হয়েছে, তা বলা হয়নি।

যা বলা হয়েছে, কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা সভ্য সমাজের কাজ নয়। সে সেলিব্রিটি হলেও নয়।

হুমায়ূন গুলতেকিনের লেখালেখি নিয়ে সমাজ উচ্ছ্বসিত হতে পারে, গুলতেকিনের বই প্রকাশে অভিনন্দন জানাতে পারে, কিন্তু গুলতেকিন মধ্যবয়সে আবার বিয়ে করলেন বলে, তা নিয়ে এই সমাজের এতো উচ্ছ্বসিত হওয়ার তো কিছু নেই!

বিবাহবিচ্ছেদের পর গুলতেকিন খারাপ ছিল না ভালো ছিল, একাকিত্ব ভোগ করেছিল নাকি দোকাকিত্ব বোধ করেছিল, তা কি এই সমাজের কাছে এসে বলেছিল? দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ার আগে সমাজের পরামর্শ চেয়েছিল? দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে সমাজকে জানিয়েছিল?

গুলতেকিন যা যা করেছে, নীরবে নিভৃতে করেছে নিজের স্বাধীনতায়। এখন দলবেঁধে অভিনন্দন জানানোটা কি গুলতেকিনের প্রাইভেসি নষ্ট করে দেয়া নয়?

তাছাড়া যারা আজ গুলতেকিনের এই আপাত মহান সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে, তারা কি গুলতেকিনের এই সাহস আত্মমর্যাদা নিজের পরিবারের সদস্যদের বেলায় মেনে নিবে?

যদি নেয়, তাহলে এই অভিনন্দনের ফুলঝুরি ঠিক আছে, নইলে বলবো, পুরোটাই ভণ্ডামি।

মোটা দাগের সত্যটা হলো এই,
বাংলার পুরুষ বা নারী ট্যাবু ভাঙার ব্যাপারে আজও এক চুল এগোয়নি।

শেয়ার করুন: