প্রমা ইসরাত:
হাঁস ছিলো, সজারুও (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেলো হাঁসজারু কেমনে তা জানি না।
সুকুমার রায়ের “খিচুড়ি” পড়লে আমার খুব আনন্দ হয়, আবার সেই সাথে বেদনা হয় কারণ আমাদের দেশের আইনগুলোর কয়েকটা এই খিচুড়ি কবিতার মতোই।
কেস স্টাডি ১-
ফয়সাল ও পূজা তিন বছর আগে বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ অনুযায়ী বিয়ে করেন। বেশ কিছুদিন একসাথে বসবাসের পর নানান মতবিরোধ থাকার কারণে তারা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আলাদা থাকা শুরু করেন।
কেস স্টাডি ২-
সালমান আর অঞ্জলি একজন আরেকজনকে ভালোবাসেন, তারা বিয়েও করতে চান। কিন্তু অঞ্জলি বিবাহিত। দুই বছর আগে তার ধীমান নামক এক ব্যক্তির সাথে হিন্দু ধর্মমতে বিয়ে হয়, কিন্তু ধীমানের সাথে অঞ্জলি নানান মতবিরোধ এবং শারীরিক মানসিক নির্যাতনের জন্য একসাথে থাকতে পারেনি।
আইনজীবী হিসেবে দুইটি কেইস সম্পর্কে জেনেছিলাম, কিন্তু ভেবে কূল পাইনি ইহা লইয়া আমি কী করিবো।
১৮৭২ সালের এই আইনটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে অনেকগুলো বিষয় এসে হাজির হয়। আইনটি ১৪৭ বছর আগের। ব্রিটিশরা এই আইনটি ভারতীয় উপমহাদেশে দিয়ে গিয়েছিলেন, যেন যেকোনো ধর্মের মানুষরা নিজেদের ধর্মকে সাইডে রেখে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন।
এই আইন থাকলেও আইনটি একটি অদ্ভুত আইন।
যেমন আইনটির নাম বিশেষ বিবাহ আইন। বিশেষ বিবাহ আবার কী? প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারী পরস্পর পরস্পরকে বিয়ে করবে। যেটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের দলিল ১৯৪৮ এর অনুচ্ছেদ ১৬ তে বলা আছে- বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার। বিবাহ তো বিবাহই, বিশেষ আবার কী!
যাই হোক, যেহেতু মুসলিম বিবাহ, হিন্দু বিবাহ, খৃস্টান বিবাহ আছে, অর্থাৎ পারসোনাল ল যেহেতু আছে, সেইজন্য বিশেষ বিবাহ নামে আরো একটি আইন দিতে হলো।
বিশেষ বিয়ের নিয়ম-
বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে বিয়ে করতে হলে আইন অনুযায়ী সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। এই আইনে বিয়ে করতে হলে দুই পক্ষকেই আইনের তফসিলে প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের ঘোষণা দিতে হবে।
তফসিলে দেওয়া নির্ধারিত কাঠামো অনুযায়ী হলফনামা না করে নিজেদের মতো করে কোনো হলফনামা সম্পন্ন করা যাবে না। বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে করতে হলে ছেলে ও মেয়েকে অবিবাহিত থাকতে হবে। ছেলের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর এবং মেয়ের বয়স ১৮ বছর হতে হবে।
প্রথমে বিশেষ বিবাহ নিবন্ধকের কাছে গিয়ে যেকোনো একপক্ষ অপরপক্ষের কাছে বিয়ের জন্য লিখিত নোটিশ পাঠাবে। নিয়ম হচ্ছে, এ নোটিশ দেওয়ার ১৪ দিন পর বিয়ে সম্পাদন করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, একপক্ষ নিবন্ধকের মাধ্যমে বিয়ের ১৪ দিন আগে অপরপক্ষকে নির্ধারিত আকারে নোটিশ না পাঠালে বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে না। এ নোটিশ নিয়ে কোনো প্রকার লুকোচুরি করা যাবে না। বিয়ের সময় অন্তত তিনজন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে। পাত্রপাত্রী সশরীরে উপস্থিত থেকে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। বিয়েটি অবশ্যই বিশেষ বিবাহ নিবন্ধক বা রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে সম্পন্ন করতে হবে।
বিয়ে সম্পন্ন হলে নিবন্ধক তা সরকারি ভলিউমে নিবন্ধন করবেন এবং একটি বিয়ের নিবন্ধনপত্র প্রদান করবেন। দেশে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক এই বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের জন্য রেজিস্ট্রার বা নিবন্ধক নিয়োগ করা আছে।
কেস স্টাডি-১ অনুযায়ী, ফয়সাল আর পূজা পড়লো এক্ষেত্রে ঝামেলায়, কেননা বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ অনুযায়ী বিয়ে করে ফেললেও এই আইন অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ করার বিধান নেই।
এই আইনের ধারা ১৭ তে বলা আছে, বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হলে করতে হবে Divorce Act 1869 অনুযায়ী।
উল্লেখ্য যে ডিভোর্স এক্ট ১৮৬৯ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য প্রযোজ্য।
এখন ডিভোর্স এক্ট ১৮৬৯ এ বিবাহ বিচ্ছেদের শর্ততে এসে দেখা গেলো যে, এই আইনের ধারা ১০ এ বলা আছে, স্বামী জেলা আদালতে কিংবা উচ্চ আদালতে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করতে হবে, কিন্তু ডিভোর্সের কারণ দেখাতে হবে, তার স্ত্রীর ব্যাভিচার করেছেন এই অভিযোগ এনে।
এখন ফয়সাল পূজা’র সাথে মতবিরোধে থাকলেও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আর পূজা কোন ব্যাভিচারের সাথেও সম্পৃক্ত নন। অথচ ডিভোর্স নিতে হলে এই অভিযোগ এনে আদালতে আবেদন করতে হবে। মানে তাকে দালিলিকভাবে ব্যভিচারের সাথে সম্পৃক্ত তা প্রমাণ করতে হবে।
আবার একইভাবে এই আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী শুধুমাত্র স্বামী ব্যভিচার করেছে, এই অভিযোগ এনে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
একজন স্ত্রীকে ডিভোর্সের গ্রাউন্ড দেখাতে হলে অভিযোগ আনতে হবে যে,
– তার স্বামী ধর্মান্তরিত হয়ে গেছেন।
– নিষিদ্ধ যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছেন।
– অন্য কোন নারীকে বিয়ে করেছেন, অথবা ব্যভিচার করেছেন।
– অথবা ধর্ষণ করেছেন, পায়ুপথে সঙ্গম করেছেন,
– ব্যভিচারের পাশাপাশি অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা করেছে।
– দুই বছর কোন রকম যৌক্তিক কারণ ছাড়া ব্যভিচারের বিষয়টি নিয়ে প্রতারণা করে আসছে।
ব্যভিচার বিষয়টি এই আইনে যেহেতু উঠে আসে, সেহেতু বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ধারা ৪৯৭ এর কথাও চলে আসে। বাংলাদেশের এই পেনাল কোডও ১৫৯ বছর আগের আইন।
ডিভোর্স এক্ট ১৮৬৯ এর ধারা ১১ অনুযায়ী
স্বামী স্ত্রী যদি ব্যাভিচার করে থাকেন, তবে যার সাথে ব্যভিচার এ লিপ্ত হয়েছেন, সেই ব্যক্তিকেও জবাব দেয়ার জন্য, কো-রেস্পন্ডেন্ট করতে পারবেন।
তবে যদি ওই ব্যক্তি মারা যান কিংবা স্বামী যদি ওই ব্যক্তিকে না চিনেন, এবং তার স্ত্রী যদি বেশ্যাবৃত্তির সাথে লিপ্ত থাকেন, তাহলে কো রেস্পন্ডেন্ট করা যাবে না কাউকে।
কী পরিমাণ বেহুদা, বৈষম্যমূলক এবং অদ্ভুত আইন এটি। শুধু তাই নয়, আইনের ভাষা অত্যন্ত অপমানজনক।
স্পেশাল ম্যারেজ এক্ট বা বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ তে বিবাহের ফলে সন্তানের উত্তরাধিকারের বিষয়টিও খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী প্রয়োগ হয়ে থাকে।
মানে, নিজ নিজ ধর্ম ত্যাগের বিষয়টি, বা নিজ নিজ ধর্ম পালনের বিষয়টিও খুব একটা খাটে না এখানে। কেননা সেই ঘুরে ফিরে, অন্য আরেকটি ধর্মের নিয়মেই আসতে হচ্ছে।
এবার আসা যাক কেস স্টাডি-২ অনুযায়ী
সালমান আর অঞ্জলিও এই আইন অনুযায়ী বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ অঞ্জলি বিবাহিত এবং এই আইন অনুযায়ী পাত্র পাত্রী উভয়কেই অবিবাহিত থাকতে হবে বা বিবাহিত থাকা চলবে না।
এখন অঞ্জলি যেহেতু হিন্দু নারী, হিন্দু আইন অনুযায়ী হিন্দু নারী ডিভোর্স চাইতে পারেন না। শুধু সেপারেশনে যেতে পারেন, The Hindu Married Women’s Right to separate Residence and Maintenance Act of 1946 অনুযায়ী। ৭৩ বছর আগের আইন।
তাও যদি তার স্বামী কোন দূরারোগ্য যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, স্বামী যদি নিষ্ঠুর ব্যবহার করে, তার অনুমতি ছাড়া অনত্র অবস্থান করে, পুনরায় বিয়ে করে, ধর্মান্তরিত হয়, কিংবা অন্যান্য আইনী কারণ যদি থাকে।
হিন্দু বিবাহ বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন হওয়া আর বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া এক বিষয় নয়।
ভারতে এই আইন গুলোর সংস্কার করা হয়েছে।
ভারতের বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪, পুরানো ১৮৭২ এর আইন নং ৩ আইনটি প্রতিস্থাপিত করে, তৈরী হয়েছে।
নতুন আইনটির তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য আছে:
1. নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিবাহের একটি বিশেষ রূপ প্রদান করা,
2. নির্দিষ্ট কিছু বিবাহ নিবন্ধন করা এবং,
3. বিবাহ বিচ্ছেদ করা।
এই আইনটি তূলনামূলক ভাবে আধুনিক।বাংলাদেশে এই আইনগুলো বৈষম্যমূলক এবং সীমাবদ্ধ। এগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সিডও সনদ অনুমোদন করে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ এর অনুচ্ছেদ ২ এবং অনুচ্ছেদ ১৬.১ (গ) সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
২ নম্বর ধারায় রয়েছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১ (গ) ধারায় বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ এই দুটি অনুচ্ছেদ কে রাষ্ট্র মুক্ত করে দিলেই উপরোক্ত বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার এর জটিলতা, এবং নারী ও পুরুষের বৈষম্য গুলো বিলোপ হয়।
[অফ টপিক- অনুচ্ছেদ ২ এ আরেকটি বিষয় উল্লেখ আছে যে, ২(চ) তে- সেটা হচ্ছে, প্রচলিত যেসব আইন,বিধি, প্রথা অভ্যাস নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেগুলো পরিবর্তন অথবা বাতিল করার উদ্দেশ্যে, আইন প্রণয়নসহ সকল উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু কে করবে? উত্তর হচ্ছে রাষ্ট্র করবে। এটা রাষ্ট্র করলে, “শাড়ি” লেখক, প্রকাশক, সম্পাদকদের আইন অনুযায়ী এক হাত দেখে নেয়া যেতো।]
মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ না। সময় অনুযায়ী আইন এর সীমাবদ্ধতাগুলো নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী সংস্কার করা প্রয়োজন। কোন রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই বিষয় গুলো নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে না।
নারীবাদ, নারী অধিকার, নারীবান্ধব আইন ও সমাজ তৈরির কথা বললে, সকলেই একটা নাক সিটকানো ভাব দেখায়। অথচ নারী পুরুষ তথা মানুষে মানুষে বৈষম্য পূর্ণ আইন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা, মানুষকেই বিপন্ন করে। আর মানুষ বিপন্ন হলে মানুষের মুক্তি কী করে সম্ভব?