অভিযুক্ত নিপীড়কের দম্ভোক্তি ও কূটকৌশল

তন্ময় চৌধুরী:

সাম্প্রতিক সময়ে যতোগুলো যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে, এর প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রই অভিযুক্ত নিপীড়ক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধাপরাধীরা একাত্তরে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করে আসছে, পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যা অস্বীকার করছে। সেই হিসেবে যৌন নিপীড়কেরা অভিযোগ অস্বীকার করবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। উপরন্তু এসব ঘটনার কোনো স্বাক্ষী-সাবুদও নেই। কারণ নিপীড়ন কেউ দশজনকে সাক্ষী মেনে করে না, যা ঘটে আড়ালে-আবডালে।

অভিযোগ অস্বীকার করার ক্ষেত্রেও তাদের (বা অভিযুক্ত নিপীড়কের পক্ষের মানুষগুলোর) একটা বিশেষ প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। (ক) এতোদিন পরে কেন অভিযোগ উত্থাপন, যখন ঘটনা ঘটেছে তখন কেন বলেনি? (খ) কোনো প্রমাণ আছে? (গ) আমার সুনাম (!) ক্ষুন্ন করতেই এই অপপ্রয়াস (ঘ) বিশেষ কোনো মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব ছড়াচ্ছে (ঙ) এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে….

যাই হোক, ভূমিকা আর না বাড়াই। এই লেখার উদ্দেশ্য একজন বিশেষ অভিযুক্তের সম্প্রতি নিজের পক্ষে দেয়া ‘সাফাই’। জামিল আহমেদ। ইতোমধ্যেই তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। কন্যাসম এক তরুণীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং সেই মেয়েটি।

সাংবাদিকতায় জামিল আহমেদের কী অভিজ্ঞতা; কিংবা তিনি কোন পত্রিকা, অনলাইন বা টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করেছেন (অনুষ্ঠান সঞ্চালনা বা সংবাদ উপস্থাপনের কথা বলছি না) তা তার প্রোফাইল ফেটেও জানা যাচ্ছে না, কিন্তু নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পিআর (পাবলিক রিলেশন) সেকশনে যোগ দিায়েছেন। যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত একজনকে কিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হলো, সেটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায় (এ ক্ষেত্রে ভিক্টিম সরাসরি এনএসইউ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করলে কোনো সুরাহা পেতে পারেন বলে মনে করি)।

যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপনের পর জামিল তার স্ট্যাটাসে কী লিখেছিলেন, সেটি নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।

গত ১৪ নভেম্বর দেয়া তার স্ট্যাটাসটিতে জামিল বলেছেন: (I would like to say a few words about some recent activities by a group of people tagging my name to a vicious campaign.) অর্থাৎ তার দাবি একটি ‘চক্র’ তার বিরুদ্ধে ‘ন্যাক্কারজনক অপপ্রচার’ চালাচ্ছে।

দেখুন, প্যাটার্ন মিলে যাচ্ছে কিন্তু। একটি মেয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপনের পর স্বাভাবিক নিয়মেই সেই অনলাইনে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যেমনটি বিশ্বের নানা দেশে ‘মিটু’ অভিযোগের ক্ষেত্রে হয়েছে। আর তিনি বলছেন, একটি চক্র উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে!

জামিল আরো বলেছেন: (I would like to state that the allegations brought in the malicious campaign are absolutely concocted, fictitious and ill-founded. This story is being spread only to destroy my image, social honour, and my career that I built with 25 years of hard work..)- এটিও গৎবাধা বুলি। প্যাটার্ন অনুযায়ী চলছে সব।

এর পরের লাইনটা লক্ষ্যণীয়: I would like to add that such conspiracy is also an attempt to malign the sound growth of media and journalism of the country.

তিনি সাংবাদিকতার এমন কী দিকপাল হয়ে উঠেছেন যে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে সেটি দেশের সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রাকে বিরাট বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে?

এর পর জামিল যেটি দাবি করেছেন, সেই আরো চমকপ্রদ!

I would like to inform you all that due steps are being taken to identify those who are working behind this nasty conspiracy.

ষড়যন্ত্রকারীদের ‘মুখোশ উন্মোচনের’ হুঙ্কার দিয়েছেন স্বঘোষিত সাংবাদিক; বেশ, বেশ। প্যাটার্ন এবং ফর্মুলা অনুযায়ীই পুরোটা পথ হেঁটেছেন তিনি।

এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, অভিযোগ উত্থাপনের সাথে সাথেই জামিল তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেন। পাকা ক্রিমিনালের মতো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে গা ঢাকা দেন। তার পর ফন্দি আঁটতে থাকেন, মুখ রক্ষার। ৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগটি ভাইরাল হয়, আর প্রতিক্রিয়া জানাতে তিনি সময় নেন পাক্কা ৬ দিন।

এই সময় তিনি কী করেছেন? এই সময়টাতে তিনি ঘাপটি মেরে সোশ্যাল মিডিয়া অবজার্ভ করেছেন। যারা ‘মিটু’ আন্দোলনে সক্রিয় তাদের চিহ্নিত করেছেন। এ ছাড়া যারা নারী নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে, তাদেরকেও নজরে রেখেছেন। এর পর একে একে এই নামগুলো তার ফেসবুকের বন্ধু তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলেছেন। ‘জঞ্জালগুলোকে’ দূর করে নিজের নিজের প্রোফাইল পরিষ্কার করে তারপর আবার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

এইযে এতো ছাঁটাছাঁটি, এতে লাভ কী হলো? বলছি, তিনি যখন নিজের পক্ষে সাফাই গাইলেন (https://www.facebook.com/ajamilbd, তখন সেই স্ট্যাটাসে বিরুদ্ধ মতের কেউ মন্তব্য করার জন্য অবশিষ্ট থাকলো না। সব মন্তব্যই পড়লো তার পক্ষে। তার বন্ধু তালিকায় নেই, এমন কারো সেখানে মন্তব্য করার এখতিয়ারও রাখেননি তিনি। তার মধ্যে যদি সত্যিই সততা থাকতো, তাহলে এতো রাখ-ঢাক, কূট কৌশল এবং কাট-ছাটের মধ্যে না গিয়ে সবার জন্যই উন্মুক্ত হতো তার বয়ান। নিরাপদ বলয় খুঁজতে হতো না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.