এই সমাজে মেয়েদের নিজের বাড়ি নেই

farah_kabir
ফারাহ্ কবির

সুপ্রীতি ধর (উইমেন চ্যাপ্টার): এই সমাজে মেয়েদের নিজেদের কোন বাড়ি নেই, হয় বাবার বাড়ি, নয়তো স্বামীর বাড়ি, সেই অর্থে আমার বাড়ি বাংলাদেশ—বলছিলেন একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। (সাক্ষাতকারটি বেশ আগে নেয়া, পাঠকদের জন্য আবার তুলে দেয়া হলো)

অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন ফারাহ্ কবির, ‘আমাদের দেশে বলা হয় মেয়ে মানুষের কোন বাড়ি নেই, হয় বাবার বাড়ি, নয়তো স্বামীর বাড়ি। সেই অর্থে বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জ আর শ্বশুরবাড়ি রাজবাড়ী। তাই কেউ জিজ্ঞ্যেস করলে আমি বলি, আমার বাড়ি বাংলাদেশে।’

তিনি জানান, এ নিয়ে তার যথেষ্ট অভিমান আছে। এই দেশ, এই সমাজ, এই নিয়ম, বিশেষ করে নারীর প্রতি বৈষম্য, এসব কিছুর সঙ্গেই তার অভিমান। তাই নিজেকে বেঁধেছেন নারীর এই অধঃস্তন অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ দেওয়ার আশায়। গণমানুষের দারিদ্র্য দূর করার পাশাপাশি নারীর অধিকার আদায় এবং নারীকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব দারিদ্র্য থেকে ন্যুনতম হলেও মুক্ত করে আনা তাঁর বর্তমান কাজের অন্যতম লক্ষ্য। নারীকে পশ্চাৎপদ রেখে কোনো দেশ ও জাতি কোনোদিন উন্নত হতে পারেনি, এখানেও সম্ভব নয়।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে কাজ করে তিনি দেখেছেন, সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত হলেও সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের দেশের চেয়ে খুব একটা এগিয়ে নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীরা এখনও অবহেলিত সেইসব দেশেও।

তিনি জানান, শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। অনেকদিন পর্যন্ত স্কুলে যাওয়া হয়নি, তখন মা-ই পড়াতেন। তাঁর ভাষায়, ‘আজকের ফারাহ্ কবীর হয়ে উঠার পিছনে মায়ের অবদান অপরিসীম। মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করার মতো সবচেয়ে বড় এই শিক্ষাটা আমি মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি।’

ব্যক্তিগত জীবন জন্ম ঢাকায়, ১৯৬০ সালের ৯ জানুয়ারি। মা- কামেলা খান মজলিস, পেশায় শিক্ষিকা ছিলেন। ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল, চট্টগ্রাম খাস্তগীর উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। বাবা-প্রথিতযশা সাংবাদিক দাউদ খান মজলিস। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদ সংস্থা ভয়েস অব আমেরিকায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এক ভাই ইফসুফ খান মজলিস। ১৯৮১ সালের ১৬ আগস্ট বিয়ে করেন শাহজাহান কবিরকে। তিনি বর্তমানে এশিয়া ফাউন্ডেশনে সোশিওলজিস্ট হিসেবে কর্মরত। বড় ছেলে ইফতেখার কবির আমেরিকাতে অনার্স শেষে এখন কানাডায় পড়ছে। আর ছোট ছেলে ইসার কবির আছে স্কটল্যান্ডে। স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে।

শিক্ষা জীবন বাবার সাংবাদিকতা পেশার কারণে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। শিক্ষা জীবন তাই স্থির ছিল না। ভিকারুন্নেসা, উদয়ন, স্কলাসটিকায় পড়তে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ১৯৭৮ সালে স্কলাসটিকা থেকে ও লেভেল পাস করেন। স্টলাসটিকায় তিনি ছিলেন প্রথম ব্যাচের তিন/চারজন শিক্ষার্থীর একজন। ১৯৮০ সালে ইডেন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স। যুক্তরাজ্যের এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে উইমেন ইন পলিটিকস, দ্য কোটা সিস্টেম ইন বাংলাদেশ এই বিষয়ের ওপর পিএইচডি করছেন।

কর্মজীবন ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে গবেষণা কাজ দিয়েই শুরু হয় তার কর্মজীবন। টানা দেড় বছর এই কাজের পর যোগ দেন ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এ। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন তিনি। এরপর তিনি কাজ করেন সেন্টার ফর এনালাইসিস এন্ড চয়েস (সিআইসি) এ। এখানে তার কাজটা ছিল মূলত রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান এবং দক্ষতা বৃদ্ধি। এ ছাড়াও কাজ করেন এশিয়া প্যাসিফিক উইমেন ইন পলিটিকস এ। এতোকিছুর পর ১৯৯৭ সালে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে জেন্ডার এন্ড গভর্নেন্স অ্যাডভাইজার হিসেবে। ২০০২ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল ইউকে তে যোগ দিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় চলে যান। দেশে ফিরে আসেন ২০০৭ সালে। একই বছর ৩ জুন একশন এইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন।

তাঁর শিক্ষা, কর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি কথা হয় বর্তমানে কাজের প্রেক্ষাপট, সমাজ, রাজনীতি, নারীর অবস্থান এসব কিছু নিয়েই। নিচে তা তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন: শুরুর দিকে আপনি ঠিক কি ধরনের কাজ করেছেন ?

ফারাহ্ কবির: প্রথমদিকে নারীদের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিতাম। দলে নারীর অবস্থান, প্রার্থী হিসেবে তৈরি করাতেও কাজ করেছি। ১৯৯৭ সালে নেপালে উইমেন পলিটিকস সংক্রান্ত নীতিমাল তৈরিতে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম। ফলে প্রাথমিক একটা ওরিয়েন্টেশন তখনই আমার হয়ে গিয়েছিল। এরপর দেশে নারী বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতা নতুন মাত্রা পায়। আর আমারও ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তার অবস্থান নির্ধারণের কাজ।

প্রশ্ন: আপনি প্রায় ১৭ বছর দেশে রাজনীতিতে নারীর অবস্থান নিয়ে কাজ করছেন। আপনার কাছে নারীর অবস্থানটা এই মুহূর্তে আসলেই কোথায় আছে বলে মনে হয়।

ফারাহ্ কবির: দেশে বর্তমান রাজনীতিতে নারীর যে অবস্থা তা খুবই দুঃখজনক। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে নারীরা সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ ধারা অব্যাহত থাকে। গণ যোগাযোগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেশ লক্ষ্যণীয় হলেও এ প্রতিচ্ছবি রাজনীতি, সংসদ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেই। এই তো কিছুদিন আগের এক জরিপে দেখা গেছে, যেসব দল নারীর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে অনেক কথা বলে তাদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোন নারী নেই্। প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি এসব জায়গায় নারী নেতৃত্ব একেবারেই শূন্য।

প্রশ্ন: সংসদে নারীর সংরক্ষিত আসন নিয়ে যে টানাপড়েন রয়েছে এতে আপনার মতামত কি? ফারাহ্ কবির: সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি বা নির্বাচনে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তবে এগুলোকে ঘিরে যতো কথা হয়েছে, ততটা হয়নি এর গুণগত মান নিয়ে। কোনো রাজনৈতিক দলই সংরক্ষিত আসনে নারীর সরাসরি নির্বাচনের বিষয়টি পরিবর্তন করেনি। এ ক্ষেত্রে আমাদের এখনও অনেক কাজ করতে হবে।

প্রশ্ন: দু দুজন নারী দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনা করেছেন। তাদের কি এই বিষয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল ?

ফারাহ্ কবির: ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দুই নারী দেশ পরিচালনা করছেন। কিন্তু তারপরও কোনো রাজনৈতিক দল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এটা পুরো রাজনৈতিক মহলের ব্যর্থতা, একজন বা দুজনের নয়। রাজনীতিতে যারা আছেন তারা সে ধরনের সক্রিয় ভূমিকা রাখেননি। তবে এই সরকারের আমলে নারী নেতৃত্বে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। স্পিকার হয়েছেন নারী, দায়িত্বশীল মন্ত্রীত্বও দেয়া হয়েছে নারীকে।

প্রশ্ন: স্থানীয় সরকারে সরাসরি নির্বাচন করে নারীরা জায়গা করে নিয়েছে, কাজও করছে। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

ফারাহ্ কবির: স্থানীয় সরকারে ৪২ হাজার নারী সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন ১৪ হাজার। এটি আমাদের জন্য একটি বড় পাওয়া। তবে এখানেও একটা বড় ধরনের ফাঁকি রয়ে গেছে। সরাসরি নির্বাচন করে নির্বাচিত হলেও এঁরা ঠিক মতোন কাজ করতে পারছেন না বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আসলে আমাদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন না হওয়াতেই এই প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়ে গেছে। নির্বাচিত নারী সদস্যরা কাজ করতে গিয়ে নানা রকম হয়রানি, বাধার মুখে পড়ছেন। আরও দেখা যাচ্ছে, নারী সদস্যরা কখনই একা সম্পূর্ণ কাজ করতে পারছেন না। অধ্যাদেশে তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এ ছাড়া এলাকা নির্ধারণে রয়েছে অসঙ্গতি। একজন পুরুষ একটি এলাকায় কাজ করলেও একজন নারী সদস্যকে করতে হয় তিনগুণ বেশি এলাকায়। এই বিষয়গুলো চিন্তাভাবনা করে এগুলে এই উদ্যোগটা আরও বাস্তবধর্মী ও কার্যকরি হতো। তাদের প্রাপ্তিতে এখনও অনেক ঘাটতি আছে। তাই আমাদের এখনও এ নিয়ে অনেক কাজ করার আছে। এই নারী নেত্রীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তারা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করতে পারে, বাধার সম্মুখীন না হোন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে আপনার অবস্থান কি?

ফারাহ্ কবির: আমাদের দেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। সিডও, বেইজিং প্লাস ১০ সহ যতো ধরনের নারী সংশ্লিষ্ট সনদ এবং মানবাধিকার সনদ রয়েছে সবগুলোতেই সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি কি? জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদনের নামে সরকার তো নতুন কিছু দেয়নি, এমনকি এতোদিন ধরে নারী অধিকার কর্মীদের সব দাবি-দাওয়ারও বাস্তবায়ন করেনি, কিন্তু সেই বিষয়টি নিয়ে এতো আন্দোলনের কোন কারণও আমি দেখি না। আন্দোলনকারীদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ যেন তারা পুরো নীতিটা পড়ে বোঝেন যে সেখানে কি লেখা আছে। এই নারী উন্নয়ন নীতিটি সবারই একবার পড়া উচিত। সরকার যেটা ঘোষণা করেছে সেটা সবার জানা উচিত। মানুষ হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি মানুষেরই সমান অধিকার আছে।

আজ আমাদের নারীরা কোনখানে নেই- অর্থনীতি, প্রাথমিক শিক্ষা, কৃষি, পোশাক শিল্প এবং জনগোষ্ঠী তৈরির পিছনে নারীর যে অনবদ্য অবদান তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে? কিন্তু তাদের অধিকার দেওয়ার বেলায় এতো অনীহা কেন? তাছাড়া আমাদের দেশে সব ধর্মের মানুষ বাস করে। সবার জন্য একটা অভিন্ন আইন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেশে তা নেই। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের জন্য মুসলিম আইন প্রযোজ্য না। যে মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে এই কথা বলা হচ্ছে তারা আগে নিজেদের নিয়মগুলো মেনে চলুক। মেয়ের অর্ধেক প্রাপ্য তা দিক আগে তারা। যেখানে মেয়েদের ন্যায্য প্রাপ্যের কথা বলা হচ্ছে সেখানে তা দেওয়া হচ্ছে না। এখনও এই দেশে – মেয়ে বাবার বাড়ি ‘নাইওর’ এলে খরচ হবে অজুহাতে মেয়েকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়। এটা ঠিক ধর্মীয় রীতির মধ্যে পড়ে কিনা এ নিয়ে কেউ তর্ক তোলে না। ধর্মে লেখা আছে, মেয়েকে এইটুকু দিতে হবে। এর বেশি তাকে দেওয়া যাবে না এমন কোন কথা লেখা নেই। বরং হিবা করে আরও বেশি দেওয়ার সুযোগ আছে। ধর্মের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে – এই অজুহাত তুলে এতো আন্দোলন। কিন্তু সুদ নেওয়া, খাবারে ভেজাল মেশানো, আদম ব্যবসা এমন সব ধর্মবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় না। আসলে যারা আন্দোলন করছে ধর্মের চেয়ে ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ ই বেশি কাজ করছে তাদের মধ্যে।

প্রশ্ন: অ্যাকশন এইড এ আপনারা কি ধরনের কাজ করছেন?

ফারাহ্ কবির: এখানে আমরা মূলত ১২টি বিষয় নিয়ে কাজ করছি। ইস্যুগুলো হলো- নারীর ক্ষমতায়ন, কিশোর-কিশোরীদের অধিকার, এইচআইভি এবং এইডস, আদিবাসী, শিক্ষা, প্রতিবন্ধী, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা। মানুষের অধিকার আর নিরাপত্তা নিয়েই আমাদের মূল কাজ।

প্রশ্ন: আপনার কাজের স্বাচ্ছন্দ্য বা কষ্টগুলোই বা কোথায়?

ফারাহ্ কবির: গ্রামে যখন নারীদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের চিন্তা-ভাবনা, সহমর্মিতা, সরলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার কাজের সুবাদে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আমাদের সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যটুকু আমাকে খুব পীড়া দেয়। কষ্ট পাই যখন দেখি আমরা এতো পিছিয়ে আছি। নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটলো তা যেন আমাদের হাজার হাজার বছর পিছিয়ে দিয়েছে। নারী সমাজের উন্নতি না করে কোনো দেশের উন্নতি হতে পারে না। তবে এটাও বিশ্বাস করি, একটা গোষ্ঠী এভাবে পিছনে লেগে থাকলে কিছুটা সময় হয়তো আমাদের বেগ পেতে হবে, কিন্তু তাই বলে পিছিয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

প্রশ্ন: আপনি তো দেশি-বিদেশি সংস্থায় কাজ করেছেন। এ দুয়ের মধ্যে মৌলিক তফাৎটা কোথায়?

ফারাহ্ কবির: দেশীয় প্রতিষ্ঠানে প্রথম যখন কাজ করি তখন অনেকটাই অপরিপক্ক ছিলাম। ভিতর থেকে কিছুটা বাধাও ছিল। সেই জায়গা থেকে এখন অনেক সরে এসেছি। সরকারি পর্যায়ে কিছুটা চাপিয়ে দেওয়া কাজও করতে হয়েছে এবং হচ্ছেও। তবে আমি বলবো, দেশের নারী আন্দোলন খুবই সক্রিয় থাকার কারণে দেশের কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। এদিক বিবেচনা করলে বিদেশি সংস্থাগুলোতে নারী-পুরুষের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে বেশ ফ্ল্যাক্সিবেলিটি আছে। এখানে কাজের সুযোগ আছে। বাধাও কম। নারী বিষয়, প্রান্তিক মানুষ নিয়ে কাজ করতে আমার প্রতিষ্ঠান উৎসাহ জোগায়। প্রশ্ন: নিজের দেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

ফারাহ্ কবির: আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি যে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আমার জন্ম হয়েছে। যেখানে একেবারে স্বল্প মূল্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এ সুযোগ নেই।

প্রশ্ন: প্রতিটি মানুষের সাফল্যের পিছনে কেউ না কেউ থাকে। আপনার?

ফারাহ্ কবির: আমার সাফল্যের পিছনে আমার মা, স্বামী, শাশুড়ি, ছেলেরা তো আছেই। তবে একজন নারীর কথা না বললেই না। বলা যায়, আমি তার কারণেই এতোদূর আসতে পেরেছি। সে হচ্ছে সুফিয়া। ১৮ বছর ধরে আমার বাড়িতে আছে। ওর কারণেই আমি নিশ্চিন্তে অনেক কাজ করতে পারি। ওর কারণেই পরিবারের কোনো বিষয় নিয়ে আমাকে চিন্তা করতে হয় না।

প্রশ্ন: আপনি পরিবার ও অফিস দুটোয় ভারসাম্য রাখেন কিভাবে? ফারাহ্ কবির: আমার সংসার তো এখন বেশ ম্যাচিওরড। দুই ছেলে বড় হয়ে যার যার মতো বিদেশে পড়ছে। এখন আমার কাছে আমার ভাই থাকে। স্বামী-সংসার নিয়ে এখন বেশ ভাল আছি। অনার্স পড়ার সময় বড় ছেলের জন্ম হয়েছিল, আর ’৮৮ সালের বন্যার সময় হয় ছোট ছেলে। তখন ছেলে, পড়াশোনা, সংসার নিয়ে খুব হিমশিম খেয়েছি। তবে ওই মুহূর্তে বাবা-মা, স্বামী-শাশুড়িসহ সবার সহযোগিতা পেয়েছি। এখন তো বাবা-মা বেঁচে নেই। ছেলেরা আমার খুব ভালো বন্ধু। ওরা আমাকে কাজের উৎসাহ দেয়।

প্রশ্ন: আপনি কি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যাবেন?

ফারাহ্ কবির: প্রতিটা মুহূর্তে যে রাজনৈতিক দলের কথা বলছি বা ভাবছি তেমন দল বা পরিবেশ এখনও পাইনি। যদি এমন হয় সৎ, রাজনীতি, দক্ষ রাজনীতি পাই, যে দল শুধুই বুলি আওড়াবার জন্য না, তখন কি করবো জানি না। তবে এখন যে অবস্থায় আছে তাতে রাজনীতিতে কখনই যাবো না। তবে এই অবস্থানে থেকেও আমরা রাজনীতি করছি, মানুষের রাজনীতি। এখানে রাজনীতির বাইরে থেকেও মানুষের জন্য কাজ করছি। তবে ভবিষ্যতে——দেখা যাক।

প্রশ্ন: একান্ত নিজের কোনো ভাবনা আছে কি?

ফারাহ্ কবির: হ্যাঁ আছে। সবসময় ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি। কারণ এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। পেশাজীবনে চেষ্টা করি, চমৎকারভাবে কাজটা সম্পন্ন করতে এবং নীতি ও আদর্শে অবিচল থাকতে। আমার মতে, আমরা যদি মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। অনেক কিছুই রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করলেও ব্যক্তি হিসেবে আমারও অনেক কিছু করার আছে।

শেয়ার করুন: