গণমাধ্যম হােক জেন্ডারবান্ধব

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন:

সিনেমায় নায়ক নায়িকাকে প্রপোজ করেছে। নায়িকা রাজী না। মনের দু:খে নায়ক যায় মদ খেতে। মদ খায় আর নায়িকার কথা মনে হয় তার। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নায়কের চুল হয় উসকো খুসকো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। একেবারে কঠিন মজনু। একসময় তাকে দেখে নায়িকার মায়া হয়। সে ভালবেসে ফেলে নায়ককে। মুহূর্তে সব রঙিন। দুজন নেচে নেচে হাত ধরে ফুলের বনে গান গায়।

আবার বড়লোকের মেয়ে আর রিকশাওয়ালার ছেলে। ভালবাসাই বড়। টাকা পয়সা জীবনে সব নয় বলে প্রেমে পড়ে তারা। পুঁচকে ছেলেমেয়েরা ভালবাসা নিয়ে বড় বড় কথা বলে জ্ঞান দেয় বাবা-মাকে। রাগী বাবা মা। তারপর ঢিসুম ঢিসুম মারামারির পর বিত্তবান মেয়ের বাবা বুঝতে পারেন, জীবনে প্রেমই সব। ভালবাসাই খাঁটি। ভিলেন মরে যায়। তিন ঘণ্টার সিনেমা শেষ।

কিন্তু জীবনের গল্প তখন হয় শুরু। এরকম হিন্দী বাংলা সিনেমা দেখে ততদিনে কিছু বালক-বালিকা, কিশোর-তরুণের মনে হয় জোর করলেই প্রেম হয়। স্বপ্নের নায়িকা খুবই সস্তার। প্রেম নিবেদন করলেই তাকে পাওয়া যায়। অসম প্রেম, ধনী গরীব , শিক্ষিত অশিক্ষিত এসব কোনো বিষয়ই না। কারণ সিনেমা, টিভি তো তাই বলে!

লেখক: আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

ফলাফল রাস্তায় বিভিন্ন স্কুলের সামনে অপেক্ষা করে রোমিওরা। ভালো লাগার মেয়েটিকে প্রস্তাব দেয়। উত্যক্ত করে। মোটর সাইকেল নিয়ে পিছে পিছে আসে তার। মেয়েটি যে বিরক্ত হয় তা বখাটে বোঝে না। একসময় বখাটে ছেলেটিকে মেয়েটি যখন না করে দেয়, তখন ছেলেটি ক্ষুব্ধ হয়। তার মধ্যে নায়কোচিত ভাব ফুটে ওঠে।

কেউ কেউ তখন সিনেমার নায়কের মতো দু:খে মদ, ফেন্সিডিল খায়, কেউ খায় ইয়াবা, কেউ গাঁজা, হিরোইন, কেউ কেউ আবার খায় সীসা। বন্ধুরা উসকায়। মেয়েটি না করে দিলো! অপমান অপমান। পৌরুষে লাগে তার। চুল ফুলিয়ে হিরো তখন আরও একধাপ যায় এগিয়ে। জোর করে অপহরণ করে মেয়েটিকে। কেউ কেউ আবার ভাবে এত্তো সাহস! না করে দেয়। এসিডে ঝলসে দেয় তাকে। কখনো বা মেয়েটির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুড়ে তো মরুক বেহায়া মেয়ে! কীইবা এমন জীবনের দাম তার!

একবারও ভাবে না, মেয়েটিরও ইচ্ছে বা অনিচ্ছে বলে কিছু আছে। তারও আছে পছন্দ বা অপছন্দ করার অধিকার। প্রপোজ করলেই বন্ধুত্ব প্রেম বা বিয়ে করতে বাধ্য না সে। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজের অনেক ছেলে ধরেই নেয় মেয়েরা না বলবে না। তার আবার মতামত কী! সে তো সস্তা! তাই যখনই সে প্রতিবাদ করে, তখনই বাধে গণ্ডগোল। ধর্ষণ, নির্যাতন, এসিড দগ্ধের মতো ঘটনা ঘটতে থাকে।

সুপ্রিয় পাঠক, জোর করে প্রেম যতই সিনেমায় দেখানো হোক, বাস্তব জীবন তো আসলে সিনেমা নয়। যুগ যুগ ধরে চলা এসব প্রেমের গল্প এখন মনে হয় পাল্টানো দরকার। দু:খ পেলেই মদ খেতে হবে, কূটকৌশল করে মেয়েটিকে পেতে হবে ভিলেনের, এমন ধারণা কেন ছড়িয়ে দিতে হবে এমন একটা শক্তিশালী মাধ্যম দিয়ে ?

আসি নাটক প্রসঙ্গে। অনেক টিভি নাটকে দেখা যায় নায়িকা যখন হেঁটে যায়, নায়ক ফুল ছুঁড়ে মারে। ফুল পেয়ে নায়িকা হেসেই কুটিকুটি। সারাদিন সাজুগুজু আর ডায়ালগ দিয়েই দিন কাটে তাদের। বেশিরভাগ নাটকেই তেমন নেই কোনো মেসেজ। প্রেম করা আর প্রেমে পড়া ছাড়া যেন আর কোনো কাজ নেই কারও।

কোনো কোনো নাটকে আবার দেখানো হয় নায়িকার একাধিক নায়কের সাথে ফ্লার্ট করার গল্প। আবার নায়করাও ফ্লার্ট করে থাকে বিভিন্ন মেয়ের সাথে। এ নিয়ে নাটকে এদের মধ্যে তেমন কোনো অনুশোচনা দেখা যায় না। একটা ব্রেক আপ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আরেকজনের সাথে প্রেম শুরু করে তারা। প্রতারণা করতে থাকে একের পর এক।
এতে বিভ্রান্ত হয় দর্শক। অনেকেই ধরে নেন নাটকের নায়ক নায়িকারা যা করছে তাই ঠিক। ফলে অনেকেই তাদের জীবনে ঘটান এর প্রতিফলন। ফলাফল ঘটে নৈতিক অধ:পতন। প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, স্বামীর হাতে স্ত্রী বা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের সংখ্যা বেড়ে যায়। চট্টগ্রামের সী-বীচে পাওয়া যায় কিশোরীর লাশ। ব্রেক আপ হওয়ায় ক্ষুব্ধ কিশোর হত্যা করে কিশোরীকে। কেন দেখাতে হবে এমন সব নাটক ?

আবার বিজ্ঞাপনেও দেখা যায় সেই নারীপ্রীতি। ‘তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী তুমি গলার মালা’ বলে আরসি কোলা নিয়ে নায়ক এগিয়ে যায়। নায়িকা মুগ্ধ হয়। বন্ধুত্ব হয় তাদের। হায়রে ঢেউটিন! কোকাকোলা, চকলেট, সেভিং ক্রিম, লুঙ্গি সব তাতেই লাগে মেয়েদের। মেধা নয়, পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় তারা। সচেতনতামূলক জেন্ডার বান্ধব বিজ্ঞাপন আজ বড় জরুরি।

ফেসবুকেও আজ হাজারও ফেক আইডি। নকল সুন্দর মুখের ছবি বসিয়ে ফেক আইডি দিয়ে পাঠানো হয় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। অনেকেই না বুঝে নিয়ে নেন তাদের। ফলাফল, প্রতারণায় ভেসে যান অনেক নারী পুরুষ। নিজের সংসারের মায়াভরা মুখগুলো তখন আর ভালো লাগে না কারও। বন্ধুত্ব বানাতে থাকেন অচেনা সব মানুষদের। পানসে লাগে ঘরের স্ত্রীর কথা। স্ত্রী নি:সঙ্গতায় খুঁজে ফেরেন বাকপটু বন্ধু। খেয়েছেন? ভালো লাগে না, মন বসে না, আপনি কথা বলেন খুব সুন্দর! এরকম নানা মিথ্যে কথার ছলনায় মাথা ঘুরে যায় অনেকের। ম্যাসেঞ্জারে চলে দিনরাত চ্যাটিংয়ের খেলা। অনেক স্বামীই তখন ভুলে যান তার বোকা সরল স্ত্রী, কষ্ট করে সেই ভোর ৫টায় ঘুম থেকে ওঠে তার জন্যই গরম ভাত তরকারি রান্না করে বক্সে ভরে দিয়েছে। রঙিন চশমায় সে কষ্ট তখন চোখে পড়ে না তার। একসময় ভেঙ্গে যায় মায়াভরা ঘর। মোহ যখন ভাঙ্গে। তখন দুজন মানসিকভাবে যোজন যোজন দূরে। ঘৃণা নিয়ে জীবন হয়ে যায় পার। প্রতারণার মোহে পড়ে সহকর্মী কামরুলের সাথে জোট বেঁধে রংপুরে দিপা হত্যা করে স্বামী রথিশ চন্দ্রকে। সমালোচনার ঝড় ওঠে পত্রিকার পাতায়।

ছোট বড় কিশোর সবার হাতে আজ মুঠোফোন। এর অপব্যবহারে পর্নোগ্রাফি আজ ছড়িয়ে পড়ছে বালক থেকে বুড়োয়। বিভিন্ন গ্রুপ চ্যাটিংয়ে পোস্ট করা হয় অশ্লীল সব ছবি। এসব দেখে দেখে রাজধানী থেকে তৃণমূলে বেড়ে যায় ধর্ষণ। ছোট বড় বৃদ্ধ শিশু বাদ যায় না, অনেকেই হয় নিপীড়নের শিকার। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে কিশোরী, তরুণী।
দেখার কি কেউ নেই?

মানুষ আজ নৈতিক অধ:পতনের দিকে যাচ্ছে। যে শিক্ষক বাবার মতো। তারই লোভের আগুনে পুড়ে মারা গেল নুসরাত। গোপালগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন আরেক শিক্ষক।
কোথায় যাবো আমরা? সিনেমার বিবেকরা তিন ঘণ্টায় মাঝে মাঝে এসেই বিবেক জাগ্রত করার বাণী দেন। জীবনে আমাদের সত্যিকার বিবেকরা কই? গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না- এ ক্যাম্পেইনে কেন আমাদের অনেকের গায়ে জ্বালা ধরে? ধুমপান বিষপানের মতোই একে সচেতনতামূলক পোস্টার ভাবুন না!
একবার পুরুষরা, আপনার ছোটো মিষ্টি বোন অথবা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, রাস্তায়, বাস টার্মিলাল, মার্কেট, পথচারী পারাপারের সময় অশ্লীল চাহনিতে তার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে কিনা! খোঁজ নিয়ে দেখুন প্রতিদিন তার মন মরে যায় কিনা!

গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন অনুরোধ, নারীদের পণ্য নয়, দয়া করে মানুষ ভেবে নাটক, সিনেমা বিজ্ঞাপন বানান। নারী অবলা, নারী দুর্বল, নারী অসহায়, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, নারী নারীর শত্রু, নারী কুটনী, নারীকে যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে এসব কথা ও চরিত্র বাদ দিয়ে সাহসী, প্রতিবাদী, জেন্ডারবান্ধব, পজিটিভ নাটক সিনেমা তৈরি করুন। যত পজিটিভ নাটক তৈরি হবে তত সমাজে বাড়বে জনসচেতনতা।

শেয়ার করুন: