‘গর্ভকালীন ওড়না’ প্রস্থে বয়ঃসন্ধির মতোই

সুচিত্রা সরকার:

বয়ঃসন্ধিকাল তখনও শুরু হয়নি। হাতা-কাটা সেন্ডো গেঞ্জি পরতাম ঘরে। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে। বাইরে বেরোলে ফ্রক বা প্যান্ট শার্ট। সেইকালে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের বাড়ির বড় বোন হুঁশিয়ার করে দিলো- ‘দেখা টেখা যাচ্ছে অল্প বিস্তর! এখনই ওড়না প্রয়োজন! ছেলেদের চোখ বড্ড খারাপ’!

ছেলেদের চোখ বোঝার আগেই, মেয়েটি আমাকে সাবধান করে দিল। মেয়েটি আমার সমাজ। সমাজের কাঠামোতে বাস করা একজন সদা-সাবধানি প্রাণী।

পরদিন থেকে ওর সামনে কখনো গেঞ্জি পরে যাইনি। ধীরে ধীরে গেঞ্জির বদলে জামা। জামা বদলে হলো কামিজ। প্যান্টের বদলে সালোয়ার। আর একটি অনুষঙ্গ। ওড়না।

সুচিত্রা সরকার

ওড়নাটা জুড়ে নিলাম নিজের সঙ্গে। মোটেই ইচ্ছে করে নয়। ওটা সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। নিজেকে সামলে প্রায় চার হাত লম্বা কাপড়টি সামলানো বেশ শক্ত।

একবার গলার ওড়না রিকশার চাকায় পেঁচিয়ে গেল। ক্লাস নাইন- টাইন হবে। রিকশাচালক ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। আর বাদবাকি লোকজন বলছে, তুমি ওড়নাটা ছেড়ে দাও!

বলে কী? ওড়না ছেড়ে দেবো? ছিঃ ওরাই তো দেখে ফেলবে!
কোনোমতে বাঁচলাম। বাঁচালাম ওড়না।

আজ অবধি বাঁচিয়েই চলেছি ওটাকে। উঠতে- বসতে। চলতে- ফিরতে। তবু কি সাত খুন মাফ হয়?
ওড়না পাতলা জর্জেটের বা সিল্কের হলে চলবে না। প্রস্থে একহাত- না, অসম্ভব! ওড়না হতে হবে মোটা কাপড়ের! যেন কিচ্ছুটি আঁচ করা না যায়। প্রস্থে হতে হবে নদী-সমান।

বয়ঃসন্ধিকাল গেছে অনেককাল আগে। যখন বারো- তেরো ছিলাম।

এখন আরেক কালে এসে উপস্থিত। এও একরকম বয়ঃসন্ধি কালই। দীর্ঘদিন একরকম জীবনযাপনের পর, হঠাৎ সব যাচ্ছে পালটে আমার। চারপাশ, মানুষজন। নিজের লক্ষ্যে পথ! আরেকজনসহ সব ভাবতে হচ্ছে। এও তো বয়ঃসন্ধি কাল।

এ কালেও নিস্তার নেই (চুলে যতই পাঁক ধরুক)। ওড়না রয়েছেই। এখনও প্রস্থে আছে একই রকম।
কিছুদিন আগে অবধি ভেবেছি, আচ্ছা গর্ভকালীন মেয়েরা বিশাল এক ওড়না দিয়ে কেন পেটটা ঢেকে রাখে? কেন নিজেকে আড়াল করে? কেন রাস্তা- ঘাটে, দোকানপাটে সচরাচর কোনো গর্ভবতীকে দেখা যায় না? যতসব ঢং! বেরোলেই পারে! কে মানা করেছে! আড়াল না করলেই হয়! আচ্ছা, কোনো অন্ধবিশ্বাস কি আছে, এই গর্ভকে আড়াল করার? যে, লোকে দেখলে সমস্যা হবে?

উত্তর খুঁজিনি। প্রশ্নগুলো মন আওড়াতো। আবার সেই মনই, প্রশ্নগুলোকে মস্তিস্কের অবচেতনে পাঠিয়ে দিতো।

আজ, আজ, এক্ষুনি- উত্তরগুলো এসে হাজির! মন দেয়নি সে উত্তর! দিয়েছে সমাজ। সমাজের মানুষ।
তারা কিছু বলেনি। ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছে। যেমন কয়েকটা বলি?
কনসিভের পাঁচ মাস পর্যন্ত শাড়ি পরেই অফিস করছি। আগে যেমন করতাম। হঠাৎ লক্ষ্য করছি সবাই বিশেষ দৃষ্টিতে কোমর বরাবর তাকাচ্ছে।

বাসায় ফিরে আয়নাকে শুধোলাম- বলো তো আয়না, পেটটা কি বেশি বোঝা যাচ্ছে? খুব খারাপ দেখাচ্ছে?
আয়না তেমন কিছু বললো না।

কিছুদিন পর। দুপুরে খাবারের জন্য ক্যান্টিনে ঢুকলাম। প্রায় তেরো- চৌদ্দ জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে! বা বলা ভালো পেটের দিকে।
লোকাল বাস বয়কট করলাম। পাড়ার দোকান, বাজার- সব সব নিষিদ্ধ হলো। ডাক্তার বলেছে প্রতিদিন দু বেলা হাঁটা ‘মাস্ট’। কই হাঁটবো! পরিচিত- অপরিচিত, নারী-পুরুষ কেউ ছাড়ছে না এই অদ্ভুত ‘চাহনি’ থেকে।
ওই অস্বস্তিকর চোখগুলো এড়িয়ে কোথায় যাবো আমি?

বাসায় কেউ এলে নিজের ঘরে বসে থাকি। ঘুমিয়ে পড়ার ভান করি। ক্লিনিকে গেলে পেছনের দিকে বসি। নাটক- সিনেমা পাড়ায় প্রায় অদৃশ্য আমি। এই প্রথম রমনার বটমূল বাদ দিলাম।
তবু, তবু যখন একান্ত বেরোতে হয়, অন্যথা না করে শরীরে জড়াই সেই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। তেরো বছর বয়সে সমাজ যাকে উপহার দিয়েছিল আমায়। ওড়না!

‘গর্ভকালীন ওড়না’ প্রস্থে বয়ঃসন্ধির মতই। বেশ নিরাপদ। চোখগুলো আন্দাজ করে। পুরোটা খুঁজে পায় না। চোখগুলোর সঙ্গে ‘সাপ লুডু’ খেলে বেশ মজা পাচ্ছি।
অস্বস্তি আছে, তবে অতোটা নয়। তাই ভাবছি, ভাগ্যিস ওড়না বস্তুটা আবিষ্কার হয়েছিল। নইলে এই ‘পোড়া’ সমাজে স্বস্তি যোগাতো কে? প্রিয় আয়না এবার বললে, ‘হুম এবার ঠিক আছে।’

টিকা এবং পাদটীকা: সুপ্রিয় বুঝদার পাঠক, যারা আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত, আশা করি লেখাটার সরলীকরণ হবে না। আজকাল সরাসরি ধাক্কা দিলে নাকি হর-হামেশা চাকরি যাচ্ছে। তাই এ পন্থা!

২১.০৪.২০১৯
১২.২৫ মিনিট
দারুস সালাম, ঢাকা

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.