আমার বাবা-ভাই কি অন্যের জন্য নিরাপদ?

ওয়াহিদা তন্বী:

আমাদের বাসার গৃহকর্মীটির বয়স ১৩ বছর। কয়েকদিনের সমসাময়িক ঘটনায় আমি কেমন যেন অস্বস্তি ফিল করছি। রাতে মেয়েটি আলাদা ঘরে ঘুমায়। বাচ্চা মেয়ে পরম নিশ্চিন্তে গভীর ঘুম ঘুমোয়! আমি যতদিন থেকে বাসায় থাকছি, প্রতিরাতে ঐ মেয়েটির ঘরে উঁকি দিয়ে আসি। দেখে আসি, সে ঠিক আছে কি না?

বাসায় আমি আর আমার মা’ ছাড়া আরও চারজন পুরুষ আছে! হ্যাঁ পুরুষই বলবো, যদিও আমার ছোট ভাই দুটো খুব বেশি বড় হয়নি। ওরই সমবয়সী! একজন ক্লাস নাইন এবং টেন! আর বাকি দু’জনের মধ্যে একজন আমার বাবা, আর একজন আমার ২৩ বছরের ভাই।
আমার ভাইদের নিয়ে আমার কখনও কোন আশংকা মনে হয়নি। আর বাবা তো ঐ গৃহকর্মী মেয়েটিকে মামনী মামনী বলে ডাকে! আমার বাবা, ভাই আমার কাছে ভালো! কিন্তু জগতের সবার কাছে কি ভালো? সবার জন্যে কি নিরাপদ! এতোদিন জানতাম আমি আমার বাবা, আমার ভাইদের কাছে নিরাপদ!

কিন্তু গত পরশু দিন বাবার দ্বারা কন্যার ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাটি পড়ে খুব বিচলিত হয়েছি! এই সমাজ তো আমাদেরই সৃষ্টি! আমরা দিনকে দিন নীরব থেকে অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়েছি! আমি মেয়েদের বলবো, আপনারা নীরব থাকবেন না আর! যখনই কোন অন্যায়, অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, তখনই প্রতিবাদ করুন!

ওয়াহিদা তন্বী

আমি একজন মেয়ে, একজন বোন। আমি আমার বাসায় বড় হয়েছি স্বাধীনভাবে। খুব বেশি বিধিনিষেধ আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি কেউ! আমি যখন ঘর গুছাতাম, তখন আমার বুকে ওড়না থাকতো কিনা, এই নিয়ে খুব বেশি সচেতন ছিলাম না। এখনও আমার ছোট ভাইদের সামনে আমি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করি। কারণ আমি ওদের বোঝাতে চেয়েছি বস্তুগতভাবে ছেলে এবং মেয়ের শারীরিক গঠনের পার্থক্য রয়েছে। মেয়েদের আলাদাভাবে দেখার দরকার নাই।

আমার মনে পড়ে, আমি এসএসসি পরীক্ষার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা সবাই মিলে একই খাটে শুয়ে টিভি দেখতাম! আমার ছোট ভাই দুটো তখন খুবই ছোট।
৬ ফিট বাই ৭ ফিটের বক্স খাটে একদিকে আব্বু, তার পাশে আম্মু, এবং পায়ের কাছে আমার ছোট ভাইরা, আর আমি অনেকটা আধশোয়া হয়ে টিভি দেখতাম! কখনো কখনো টিভি দেখতে দেখতে আব্বু-আম্মুর বেডরুমে ঘুমিয়ে যেতাম!
কী নির্ভরতা, কী সুন্দর স্মৃতিময় ছিল সেই দিনগুলি!

আমরা মেয়েরা বাবার কাছে আশ্রয় খুঁজি। বাবাকে সবার থেকে আলাদা ভাবি। বাবার ভালবাসা অন্য কারো ওজনে পার্থক্য করা যাবে না! বাবা কখনো শাসন করতো না! মায়ের বকুনি থেকে বাঁচার জন্যে বাবার কাছে নালিশ করতাম! বাবার কাছেই যত আবদার, যত অভিমান, যত চাওয়া, পাওয়া! ভুল ত্রুটি নিয়েই মানুষ, কিন্তু আমার বাবা কখনো কুদৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাতো না! বাইরের মেয়েদের কেমন দৃষ্টিতে তাকাতো, তা আমি জানি না!

আমরা এক সময় আমাদের পরিবার নিয়ে গর্ব করতাম। আমার মনে হয়, একটা বিশেষ গোষ্ঠী আমাদের সুখী পরিবারগুলোতে কালিমা লেপে দিতে চায়! পরিবারগুলোতে ভাঙন ধরাতে চায়! একটা শিশুর নিরাপদ আশ্রয় তার বাবা-মা। তার নিজের ঘর! তাই আমাদের উচিত সচেতন হওয়া, আমরা যেন শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করি! তাদের ভালো থাকাটা নিশ্চিত করি।

আজ আমাদের বাসার বুয়া খালাকে বললাম, খালা আপনার সাত বছরের শিশু কন্যাকে বাড়িতে রেখে আসবেন না! সাথে করে নিয়ে আসবেন। যতক্ষণ আমাদের বাসায় থাকবেন, কাজ করবেন, আপনার মেয়েকেও সংগে রাখবেন। স্কুল শেষ করে মেয়েকে বলবেন, আমাদের বাসায় এসে খেলবে!
খালা আমার কথায় যেন অবাক হলেন। তার চোখ ছলছল করে উঠলো। বললো, আম্মু তোমার মতো যদি আমাগো গরীব মানুষের মাইয়ার কথা এমন করে কেউ ভাবতো। ভালই করছেন, আমারে সাবধান কইরা। আমি আমার মাইয়াটারে আগলায় রাখুম! যে দিনকাল পড়েছে! কী থেকে যে কী হইয়া যায়!

আসুন, আমরা আমাদের পরিচিত মণ্ডলে মায়েদের সচেতন করি। বিশেষ করে যেসব মায়েরা অশিক্ষিত এবং সমাজের এই নোংরা দিকগুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়, তাদের সচেতন করি! পাশাপাশি যাদের নিয়ে এতো সমস্যা সেই নিজের বাসার পুরুষ তথা ছেলেদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করি!

ভালো থাকুক সকল মা বাবারা। ভাল থাকুক প্রতিটি কন্যা শিশু। আমরা সকলে মিলে ঐ জানোয়ারটার বিচার চাই!!!

শেয়ার করুন: